সাতসতেরো

কিংবদন্তি এক গানের কোকিল

শাহ মতিন টিপু : বাংলাদেশের লোকসংগীতের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম আবদুল আলীম। কণ্ঠস্বরের অসাধারণ ঐশ্বর্য্য নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন। লোকসংগীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদি, ইসলামি ইত্যাদি গানের শিল্পী হিসেবে আজও তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আবদুল আলীমের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। কালজয়ী এই লোকসংগীত শিল্পী মাত্র ৪৩ বৎসর বয়সে ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে (বিসিএএমইউ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ আবদুল আলীম নেই। কিন্তু আছে তার গান। তার গানের মাঝে তিনি সংগীতপিপাসু জনগণ- তথা পল্লিগ্রামের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।বরেণ্য গীতিকার প্রয়াত অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল তার এক নিবন্ধে লেখেন, ‘আবদুল আলীম পূর্ব বাংলার মানুষ ছিলেন না। পশ্চিম বাংলা থেকে এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু তার গলায় ছিল পূর্ব বাংলার নদীর কল্লোল। শুধু বেতারে গান শুনেই বাংলাদেশের মানুষ তাকে আত্মীয় হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আব্বাসউদ্দীনের পরে আমাদের লোকসংগীতের ইতিহাসে আবদুল আলীম এক অবিস্মরণীয় নাম। বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষের অন্তর থেকে উৎসারিত গানে এত দরদ আর কেউ কখনো মেশাতে পারেননি। বর্ষার উচ্ছ্বসিত পদ্মা-মেঘনা-যমুনার তরঙ্গের মতো আবদুল আলীমের ভরাট গলার স্বর শ্রোতার চৈতন্যের তটভূমিতে ভেঙে পড়ত অবিরল।’তিনি আরো লেখেন, ‘আমাদের লোকসংগীতের সঙ্গে কত নিবিড়ভাবে আলীম একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। গানের কথা ও সুর তার কণ্ঠের সহযোগে যেন স্পর্শগ্রাহ্য হয়ে উঠত। পশ্চিম বাংলার সন্তান হয়েও পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক উচ্চারণ রীতি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন সহজে; উত্তর বাংলার ভাওয়াইয়া গানের ভাষাও তার কাছে কোনো অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়নি। ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়ার অকল্পনীয় সুর-বৈচিত্র্যে আবদুল আলীম মুহূর্তেই রাজধানীর উজ্জ্বল মঞ্চে গ্রাম-বাংলার বিভ্রম রচনা করতে পারতেন। কার্জন হলে, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে কতবার আমরা তার গান শুনেছি আর ফিরে গেছি গ্রামীণ জনপদে, অবারিত প্রান্তরে অথবা নদীর বিস্তারে। সেসব কথা মনে পড়লে বড় কষ্ট হয়। বুকের ভেতরে এক অপরিমেয় শূন্যতা হু-হু করে ওঠে।’সত্যিকার অর্থে এই হচ্ছেন আমাদের গানের পাখি আবদুল আলীম। দরাজ কণ্ঠের অধিকারী এই শিল্পীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই। পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সংগীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক। খুব অল্প বয়স থেকেই শিল্পী গান গেয়ে নাম করেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়।জানা যায়, অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোনো শিক্ষকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। তিনি অন্যের গাওয়া গান শুনে গান শিখতেন। আর বিভিন্ন পালা পার্বণে সেগুলো গাইতেন। ১৯৪২ সাল। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বড় ভাই শেখ হাবিব আলী আব্দুল আলীমকে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে।শিল্পী ধীর পায়ে মঞ্চে এসে গান ধরলেন, ‘সদা মন চাহে মদিনা যাব।’ মঞ্চে বসে আবদুল আলীমের গান শুনে ‘শেরে বাংলা’ শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। কিশোর আলীমকে জড়িয়ে নিলেন তার বুকে। উৎসাহ দিলেন, দোয়া করলেন এবং তখনই বাজারে গিয়ে পাজামা, পাঞ্জাবি, জুতা, পুটি, মোজা সব কিনে দিলেন। এই হচ্ছেন আব্দুল আলীম। তার গানে আপ্লুত হয়নি এমন লোক বিরল।তার কিছু অবিস্মরণীয় গান- নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা, সর্বনাশা পদ্মা নদী, হলুদিয়া পাখী, মেঘনার কূলে ঘর বাঁধিলাম, এই যে দুনিয়া, দোল দোল দুলনি, দুয়ারে আইসাছে পালকি, কেন বা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ, মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায় ইত্যাদি।১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের একমাস আগে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এলেন। ওই বছরেই ডিসেম্বর মাসে ঢাকা এলেন। পরের বছর ঢাকা বেতারে অডিশন দিলেন। অডিশনে পাশ করলেন। ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসের ৯ তারিখে তিনি বেতারে প্রথম গাইলেন, ‘ও মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও।’এরপর পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের সঙ্গে আবদুল আলীমের পরিচয় হয়। কবি জসীম উদ্দিন তাকে পাঠালেন জিন্দাবাহার দ্বিতীয় লেনের ৪১ নম্বর বাড়িতে। এক সময় দেশের বরেণ্য সংগীত গুণি শিল্পীরা এখানে থাকতেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ মমতাজ আলী খানের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। মমতাজ আলী খান আবদুল আলীমকে পল্লী গানের জগতে নিয়ে এলেন। পরবর্তীতে তিনি কানাই শীলের কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করেন।গান শেখার ক্ষেত্রে আর যারা তাকে সব সময় সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন- তাদের মধ্যে বেদার উদ্দিন আহমেদ, আবদুল লতিফ, শমশের আলী, হাসান আলী খান, মো. ওসমান খান, আবদুল হালিম চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লোকসঙ্গীতের অমর কণ্ঠশিল্পী মরহুম আববাস উদ্দিনের পরামর্শক্রমে তিনি ওস্তাদ মো. হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম গ্রহণ করেন।বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ‘লালন ফকির’। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল তার।যাদুকরী কণ্ঠের অধিকারী আব্দুল আলীম জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সংগীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে।আবদুল আলীমের জ্যেষ্ঠছেলে জহীর আলীম তার এক নিবন্ধে লেখেন, ‘তিনি ১৯৬২ সালে বার্মায় অনুষ্ঠিত ত্রক্ষীয় সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। বার্মায় তখন অনেকদিন যাবৎ ভীষণ খরা চলছে। গরমে মানুষের প্রাণ বড়ই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘের আনাগোনা। শিল্পী অন্যান্যদের সঙ্গে মঞ্চে উঠলেন গান গাইতে। গান ধরলেন- `আল্লা মেঘ দে পানি দে।` কী আশ্চর্য! গান শেষ হতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো। অনুষ্ঠানে বার্মার জনৈক মন্ত্রী বললেন, `আবদুল আলীম আমাদের জন্য বৃষ্টি সঙ্গে করে এনেছেন। তখন থেকেই শিল্পী বার্মার জনগণের নয়ন মণি হয়ে আছেন।’সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে তিনি ১৯৬৩ সালে রাশিয়া এবং ১৯৬৬ সালে চীন সফর করেন। এই দুটি দেশে তিনি পল্লিগান পরিবেশন করে দেশের জন্য প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেন। বিদেশে বাংলাদেশের পল্লিগানের মান বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে আবদুল আলীমের অবদান অনস্বীকার্য।

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫/টিপু/সাইফুল