সাতসতেরো

নাচোলে ঝড় তোলা রানি

শাহ মতিন টিপু : ইলা মিত্র। যিনি সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বেচ্ছায় জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। তবু থেমে যায়নি তার আদর্শের লড়াই। ইলা মিত্র এক সংগ্রামের নাম। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে গেছেন এই সংগ্রামী নারী। কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়ে শোষিতের পাশে দাঁড়িয়েছেন আবার শিক্ষকতা করে অগণিত শিক্ষার্থীকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। ইলা মিত্রকে বলা হয় নাচোলের রানি। বরেন্দ্র ভূমির লালমাটির দেশ নাচোলে অনগ্রসর পিছিয়ে থাকা সমাজ থেকে উঠে আসা ইলা মিত্র নারী হয়েও তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সমগ্র বিশ্বকে তেভাগা আন্দোলনের সূচনা করে। কিন্তু এই আন্দোলনের অবসান ঘটে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। আদিবাসী সাঁওতালদের রানিমা ইলা মিত্রের গ্রেফতার বরণের মধ্য দিয়ে ওই মহা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও, তার রেশ ও প্রেরণা কোনো দিনও নিশ্চিহ্ন হবে না। ১৯৪৮ সালে এক শিক্ষিত নারী বিবাহের সূত্র ধরে বধূ হিসেবে শ্বশুরের জমিদারির অংশ নাচোলে বেড়াতে আসেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুর হাট এলাকার জমিদার রমেণ মিত্র ও তার সুযোগ্য সহধর্মিণী ইলা মিত্র। পড়াশোনার সূত্র ধরেই কলকাতায় পরিচয় এবং সেখানেই বিয়ে। কিন্তু তারা দুজনেই তৎকালীন মালদহ জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। বিবাহের সূত্র ধরে ইলা মিত্রের শ্বশুরবাড়িতে আগমন ও শ্বশুরের জমিদারি এলাকা নাচোলে বেড়াতে যাওয়া। এ সময়ে সমগ্র নাচোল ছিল বিশাল গভীর জঙ্গলে ভরা। বরেন্দ্র অঞ্চলের আদিবাসী সাঁওতালরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে পেটের তাগিদে জঙ্গল কেটে, পরে কোদাল গাইতি চালিয়ে সেই জঙ্গলকে জমি বানিয়ে চাষাবাদ করত। জংলাজমি পরিষ্কার করে ফলাত সোনার ফসল। কিন্তু জমির মালিক হতে পারত না। যে মুহূর্তে জঙ্গলকাটা জমি সোনার ফসলে ভরে উঠত, ঠিক সেই মুহূর্তে লোলুপ দৃষ্টি পড়ত ব্রিটিশদের পেটোয়া চাকর-বাকর মার্কা জমিদারদের। রাতারাতি ব্রিটিশদের আশীর্বাদে জমির মালিক বনে গিয়ে কোনো প্রকারের চাষবাস বা জঙ্গল কাটার মজুরি না দিয়ে অধিকাংশ ফসলই নিয়ে যেত। আরো একহাত এগিয়ে এসব জমি জমিদারদের নায়েবসহ বিভিন্ন কর্মচারীরা লিজ নিয়ে রাতারাতি বনে যেত জোতদার। এসব জোতদারের অত্যাচার ছিল আরো অমানবিক। তারা সাঁওতালদের উদ্ধার করা জমির মালিক সেজে বাধ্য করত তাদেরই জমি চাষ করাতে। অর্থাৎ যারা জঙ্গল কেটে জমি তৈরি করল, তারাই হয়ে গেল রাতারাতি জোতদারের বর্গাচাষি। যুগের পর যুগ এভাবে বর্গাচাষি সেজে জমি চাষ করলেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন না হয়ে জোতদারের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়ে আসছিল। ফলে অসহায় বর্গাচাষিরা ফসলের তিন ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে গোপনে কথা বললেও সাহস ছিল না প্রকাশ্যে বলার ও প্রতিবাদ করার। অর্থাৎ তিন ভাগের এক ভাগ (ফসলের) পাবে জোতদার, আর বাকি দুভাগ পাবে বর্গাদার চাষিরা। আর এই অধিকারের নামই ছিল তেভাগা।ইলা মিত্র শ্বশুর ও স্বামীর জমিদারিতে বেড়াতে গিয়ে অনুধাবন করেন চাষিদের বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি। ইলা মিত্র রাতারাতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে তাদের কষ্টের বিষয়টি পুরোপুরি অনুধাবন করে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে সশরীরে জমিদার, জোতদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সাঁওতালদের তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে একধরনের অধিকার আদায়ের যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আদিবাসী সাঁওতাল কৃষকরা অনেক দিন পর নারী নেতৃত্বের হাত ধরে ফুঁসে ওঠেন সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চলে। আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ইলা মিত্র। আন্দোলন যখন চরম চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন শুরু হয় ষড়যন্ত্র। তৎকালীন সরকার একে ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যে ফেলে ভূস্বামী অর্থাৎ জমিদার জোতদারদের ইন্ধনে সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিয়ে আন্দোলনকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে সময়ে আন্দোলনে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে নাচোল থানার পাঁচ পুলিশ নিহত হলে তড়িঘড়ি সেনা মোতায়েন করা হয়। সেনাবাহিনী প্রতিশোধ নিতে গ্রামের পর গ্রাম নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আদিবাসীরা প্রাণ নিয়ে এলাকা ছেড়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। শত শত আদিবাসী গ্রেফতার বরণ ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়। এই সময়ে ইলা মিত্রের স্বামী রমেন মিত্র স্ত্রীর সঙ্গে থেকে আন্দোলনের মাঠে থাকলেও সেনাবাহিনী ও পুলিশের অমানবিক অত্যাচারের চিত্র স্বচক্ষে দেখার পর নিরাপত্তার কারণে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। একইভাবে ইলা মিত্র দেশত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তাই ছদ্মবেশে গোমস্তাপুর থানার রহনপুর রেলস্টেশনে অবস্থানকালীন পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সেদিন ছিল ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। আর সেই দিন থেকে নেমে আসে যবনিকা তেভাগা আন্দোলরে ওপর। স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো আন্দোলন। ইলা মিত্রকে নিয়ে যাওয়া হয় নাচোল থানায়। শুরু হয়ে যায় বর্বর বাহিনীর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। যার বর্ণনা দেওয়া খুবই কঠিন। ফলে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে ইলা মিত্রকে ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি রাজশাহী কারাগারে প্রেরণ করে। ১৪ দিনের অমানবিক শারীরিক নির্যাতনে সর্বক্ষণ অচেতন থাকলেও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি। একই বছরের নভেম্বরে নাচোল হত্যা নাম দিয়ে মামলা পরিচালনায় নামে সরকার। রাজশাহী প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আহম্মেদ মিঞার কোর্টে শুরু হয় মামলার প্রাথমিক কার্যক্রম। কিন্তু চিকিৎসা না করায় নারীনেত্রী ইলা মিত্র মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছলে ১৯৫৪ সালে প্যারোলে মুক্তি দিলে উন্নত চিকিৎসা নিতে ভারতে চলে যান।তেভাগা আন্দোলনের এই বিপ্লবী রানিমাতা এরপর সুস্থ হয়ে কলকাতা থেকে না ফিরে সেখানে অবস্থান নিয়ে গড়ে তোলেন নিজের অসম্পূর্ণ ক্যারিয়ার। তিনি লেখাপড়ায় মনোযোগ দিয়ে ১৯৫৭ সালে এমএ পাস করেন। এরপর সক্রিয় হয়ে ওঠেন রাজনীতিতে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তিনি চারবার নির্বাচিত হয়ে (মানিকতলা আসন) জনগণের সেবা করেছেন। সিপিআই নেতা হিসেবে ১৯৬৭ ও ১৯৭২ সালে বিধানসভায় কমিউনিস্ট পার্টির ডেপুটি লিডার ছিলেন। বিপ্লবী ইলা মিত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে পাঁচবার নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন ভারতের মহিলা ফেডারেশনের জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পশ্চিমবাংলা মহিলা সমিতির সভাপতি। এ ছাড়া তিনি ছিলেন ভারত-সোভিয়েত সংস্কৃতিক সমিতির সহসভানেত্রী। ইলা মিত্র সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন ক্রীড়াক্ষেত্রেও। পাশাপাশি ছিলেন লেখিকা। ইলা মিত্র বেশ কয়েকটি রুশ গ্রন্থ অনুবাদ করেন। এগুলো হচ্ছে- ‘জেলখানার চিঠি’, ‘হিরোশিমার মেয়ে’, ‘মনে প্রাণে’-২ খন্ড, ‘লেনিনের জীবনী’ ও ‘রাশিয়ার ছোট গল্প’। ‘হিরোশিমার মেয়ে’ বইটির জন্য তিনি ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু’ পুরস্কার লাভ করেন। অ্যাথলেটিকে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়া ভারত সরকার তাকে স্বাধীনতাসংগ্রামী হিসেবে স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মানে তাম্রপত্র পদকে ভূষিত করে সম্মানিত করে।ইলা মিত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় সব ধরনের সহযোগিতাসহ আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষকে বড় ধরনের সমর্থন দিয়েছেন। তাদের জন্য মাঠে নেমে কাজ করেছেন। তিনি তার একটি জবাবনবন্দিতে বলেছেন, ‘আমি দুইবার কবর হতে উদ্ধার হয়েছি। একবার বন্ধ শ্বশুরালয় এবং দ্বিতীয়বার পাকিস্তান কারাগার। এ দুটো কবর হতে দুবার যারা আমাকে উদ্ধার করেছেন, তাদের মুক্তিসংগ্রামের পেছনে পড়ে থাকার মতো অকৃতজ্ঞ কিভাবে আমি হই।’১৯৯৬ সালে ৫ ও ৬ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ সফরে এলে স্মরণাতীতকালের বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় নাচোলের মাটিতে। তিনি সংগ্রামের অর্থাৎ তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি আরো একবার নাচোলে আসতে চেয়েছিলেন। ১৩ অক্টোবর ২০০২ সালে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর। নাচোলবাসীর কাছে তিনি আজও কিংবদন্তি। তার স্মরণে নাচোলের কেন্দুয়াতে নির্মাণ করা হয়েছে তেভাগা স্মৃতিস্তম্ভ।

   

রাইজিংবিডি/ ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৫/টিপু/এএন