সাতসতেরো

মালা ও কয়েকটি কুকুর

রণজিৎ সরকার : দাঁড়ালাম। সোহরাওয়ার্দী মাঠের ভেতর। ছবিরহাটের দক্ষিণ দিকে। লালন মঞ্চের পাশে। একটা কুকুর শুয়ে আছে। তিনটি বাচ্চা কুকুর মায়ের দুধ খাচ্ছে। আর দুটি বাচ্চা ঘোরাঘুরি করছে। মা কুকুরের আশপাশ দিয়ে। দৃশ্যটা দেখে মনে পড়ল আমার শৈশবের কথা। মনে পড়ল মায়ের কথা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। দৃশ্যটা দেখছি। হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ল আমার। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ভারতের প্রেসিডেন্ট ভবনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় কঠোর নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে আকস্মিকভাবে একটি রাস্তার কুকুর ঢুকে পড়ে সেখানে। এই ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। কুকুর নিয়েই। এর মধ্যে আট-নয় বছরের একটা শিশু এল। দাঁড়াল আমার পাশে। কুকুরগুলোর দিকে তাকাল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম। একটু পর আমার বাঁ হাত ধরল ও। তার ডান হাত দিয়ে। আমি ভাবলাম, কুকুরের বাচ্চাগুলো দেখে হয়তো সে ভয়ে পেয়ে আমার হাত ধরেছে। আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। দেখি সে কি বলে। একটু পর শিশুটি বলল, ‘ভাইয়া, মোবাইল নাই?’বললাম, আছে।বাঁ হাত দিয়ে কুকুরগুলো দেখাল। তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কুকুরগুলোর ছবি ওঠান।’তাকালাম ওর দিকে। তারপর বললাম, আমি যে মোবাইল ব্যবহার করি। সেটা দিয়ে ছবি তোলা যায় না। শুধু কথা বলা যায়। কমদামি মোবাইল তো।

আমার কথা শোনার পর দেখি ওর মন খারাপ হয়ে গেল। আমি যদি মোবাইলে কুকুরগুলোর ছবি তুলতে পারতাম। তাহলে সে খুশি হতো। মজা পেত। ছবি না তোলাতেই তার মন খারাপ হলো, এটা আমি বুঝতে পারলাম। মন ভালো করার জন্য আদর দিয়ে ওর মাথার চুল নাড়তে নাড়তে বললাম, তোমার নাম কী?দুই হাত দুই দিকে লম্বা করে বলল, ‘আমার নাম এতগুলো। অনেকেই অনেক নামে ডাকে।’আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর ভঙ্গি দেখে। বললাম, তোমার আসল নামটা বলো?মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘আমার নাম মালা।’তুমি মালা বিক্রি করো বলে তোমার নাম মালা?

মাথা নাড়াল। কুকুরের দিকে হাত দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, দেখেন দেখেন, মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য দুইটা বাচ্চা কেমন করছে।’আবার তাকাল। কুকুরগুলোর দিকে। আশপাশের বেশকিছু মানুষ এসে দাঁড়াল। তারাও দেখছে দৃশ্যটা।মালাকে বললাম, আচ্ছা, এই কুকুরগুলো কি এখানে থাকে?’মালা বলল, ‘না না ভাইয়া, মাঝে মাঝে এখানে আসে। আবার কোথায় যেন চলে যায়। অনেকে দিন পর আজ দেখতে পাচ্ছি।’বললাম, তাই।মালা বলল, ‘ভাইয়া, টাকা দেন। কুকুরগুলোর জন্য খাবার নিয়ে আসি।’

কুকুরের প্রতি মালার মায়া দেখে অবাক হলাম। সে কুকুরগুলোকে অনেক ভালোবাসে। নিজের কাছে টাকা নেই, তাতে কী। আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে কুকুরগুলোকে খাওয়াবে। এবার বুঝতে পারলাম মালা আমার পাশে এসে একটা উদ্দেশ্য নিয়েই দিয়েছে। মালাকে একশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। মালা একশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে বলল, ‘ভাংতি টাকা নেই। এত টাকা তো লাগবে না ভাইয়া। পাউরুটি কিনতে বেশি টাকা লাগবে না।’

মালার সরলতা আমাকে মুগ্ধ করল। বললাম, মালা, তোমার যা ইচ্ছা করে, তুমি তাই নিয়ে এসো। যদি টাকা আরো লাগে তাহলে নাও।’মালা বলল, ‘না না, ভাইয়া, আর লাগবে না, এই টাকা দিয়েই হয়ে যাবে।’ এই বলে মালা চলে গেল দক্ষিণ দিকে।মালা কিছু দূর যাওয়ার পর একটা লোক এসে বলল, ‘ভাই, মেয়েটাকে একশ টাকা দিলেন। সে কি আর ফিরে আসবে?’আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, অবশ্যই আসবে।

লোকটি বলল, ‘আমার মনে হয়, সে টাকা নিয়ে চলে যাবে। খাবার আর নিয়ে আসবে না।’বললাম, অপেক্ষা করেন। আমার বিশ্বাস, মালা সত্যি আসবে।

লোকটা আমার কথা শুনে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল। আমি কুকুরগুলোকে দেখছি। আর মাঝে মাঝে দক্ষিণ দিকে তাকাই। মালার জন্য। কারণ, মালা ওই দিক থেকেই আসবে।

কিছুক্ষণ পর দেখি মালা পাউরুটি নিয়ে এল। পাউরুটি কুকুরগুলোর সামনে দিল। লাফালাফি করে খেতে লাগল কুকুরগুলো। এর মধ্যে কোথা থেকে একটা পাগল এসে কুকুরগুলোকে তাড়াতাড়ি দিল। পাউরুটি মুখে নিয়ে দৌড় দিল কুকুরগুলো।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৫/রণজিৎ/রফিক