সাতসতেরো

ভারতের দুধওয়ালা

শাহ মতিন টিপু : ভার্গিজ কুরিয়েন। তাকে বলা হয় ‘ভারতের দুধওয়ালা’। ১৯২১ সালের ২৬ নভেম্বরে কেরালার কোঝিকোড়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভার্গিজ কুরিয়েনকে বলা যায় একটি বিপ্লব। আর এটা ছিল দুধ উৎপাদনের বিপ্লব। তার সাফল্য আজ সবারই জানা। এ জন্যই তাকে বলা হয় ‘শ্বেত বিপ্লবের জনক’। তার নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে ভারতজুড়ে শুরু হয় ‘অপারেশন ফ্লাড’। দুধ উৎপাদনে ভারতকে স্বনির্ভর করে তুলতে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ‘আমুল’ সংস্থা তৈরি করে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যে আমূল পরিবর্তন আনেন।

 

১৯৪৯ সালের গুজরাট। জেলা, আনন্দ। ছয় মাসের চুক্তিতে দুধের সমবায় প্রতিষ্ঠানে কাজ করছিলেন ২৮ বছরের ভার্গিজ কুরিয়েন। চুক্তি শেষ হতেই যুবকটি ব্যাগ গুছিয়ে সোজা মুম্বাই রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি। স্থানীয় বাসিন্দা ত্রিভুবন দাস প্যাটেলের আবির্ভাব। সনির্বন্ধ অনুরোধ, ‘আর ক’টা দিন থেকে যাওয়া যায় না? আমাদের সমবায়টা তা হলে একটু মজবুত করে নেওয়া যেত!’

 

বন্ধু ত্রিভুবন দাসের অনুরোধ ফেলতে না পেরে ভার্গিজ কুরিয়েন সেই যে থেকে গেলেন, তার থেকেই জন্ম নিল একটা বিপ্লব। এ দেশের গ্রামীণ সমবায় শিল্পোদ্যোগের ইতিহাসকে ‘আমুল’ বদলে দেওয়ার বিপ্লব। যার দৌলতে গুজরাটের গ্রামে ৩২ লাখ মানুষ আর্থিকভাবে স্বয়ম্ভর, যার দৌলতে ভারত বিশ্বের ১ নম্বর দুধ উৎপাদক দেশ। ৯০ বছর বয়সে ২০১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর গুজরাটেরই একটি হাসপাতালে প্রয়াত হলেন ভার্গিজ কুরিয়েন। ‘আমুল’ বিপ্লবের ইতিহাস রেখে বিদায় নিলেন এক ‘দুধওয়ালা’। কুরিয়েনের মৃত্যুতে সেই বিপ্লবের একটা যুগ সমাপ্ত হলো।

 

পড়াশোনা। চেন্নাইয়ের লয়োলা কলেজ থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। জামশেদপুরে টিসকোয় চাকরি করতে করতেই সরকারি স্কলারশিপ পান ডেইরি ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। বেঙ্গালুরুর ‘ইম্পিরিয়াল ইনস্টিটিউট অব অ্যানিমাল হাসব্যানড্রি অ্যান্ড ডেয়ারিং’-এ পাঠ শেষে আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে ফিরে চুক্তিমাফিক গুজরাটের আনন্দে দুধ থেকে ক্রিম তৈরির একটি সরকারি কারখানায় ঢুকলেন। স্থানীয় সমবায়, ‘কাইরা জেলা দুগ্ধ উৎপাদক সমবায়’-এর প্রধান ত্রিভুবন দাসের সঙ্গে সেখানেই আলাপ।

 

গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে দুধ উৎপাদন দীর্ঘদিনেরই রেওয়াজ। সমবায় প্রথাকে কাজে লাগিয়ে দুধ উৎপাদকদের জীবনে পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখাটা শুরু করেছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল। তারই উৎসাহে তৈরি হয়েছিল কাইরা জেলা দুধ উৎপাদক ইউনিয়ন। ত্রিভুবনের অনুরোধে ১৯৪৯ সালে ওই সংস্থায় যোগ দিলেন কুরিয়েন। তার পরপরই একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য কুরিয়েনকে অনুরোধ করলেন স্বয়ং বল্লভভাই। আর কুরিয়েনও  গ্রামীণ ডেইরি শিল্পের খোলনলচে বদলানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

 

শুরু হয়েছিল মাত্র দুটি গ্রাম নিয়ে। দিনে ২৪৭ লিটার দুধ আসত তখন। ১৯৫৫ সালের মধ্যে এলাকা যেমন বাড়ল, তেমনই বাড়ল দুধের পরিমাণ। দৈনিক ২০ হাজার লিটার। গরুর দুধে আটকে না থেকে মহিষের দুধকে কাজে লাগানোর পথিকৃৎ কুরিয়েনই। কুরিয়েনরা অনুভব করলেন, এবার একটা ‘ব্র্যান্ডনেম’ দরকার। ওদের মধ্যে থেকেই একজন বললেন, ‘আনন্দ মিল্ক ইউনিয়ন লিমিটেড!’ আর তাই ১৯৫৫ সালে আত্মপ্রকাশ করল দুধ ব্র্যান্ড ‘আমুল’।

 

শ্বেত বিপ্লব, অপারেশন ফ্লাড, ন্যাশনাল ডেইরি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, গুজরাট কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন... আরও যত ধাপই পেরোক না কেন কুরিয়েনের কর্মযজ্ঞ, শুরুটা ওই তিনটি বর্ণে ‘আমুল’।

 

‘আমুলে’র সাফল্যে উদ্দীপিত হয়েই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী উদ্যোগী হয়েছিলেন ন্যাশনাল ডেইরি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা এনডিডিবি (১৯৬৫) গড়ার কাজে। কুরিয়েনই তার কর্ণধার হলেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৭০ সালে দেশ জুড়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ‘অপারেশন ফ্লাড’-এ নামল এনডিডিবি। গুজরাটে অবশ্য ‘আমুল’-মডেল তার আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল। গোটা রাজ্যের দুগ্ধ সমবায়গুলিকে এ বার এক ছাতার তলায় আনলেন কুরিয়েন। ১৯৭৩ সালে গড়ে উঠল গুজরাট কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন। আনন্দ-এর চৌহদ্দি ছাড়িয়ে গোটা গুজরাটের প্রতিনিধি হয়ে উঠল ‘আমুল’ সারা ভারতের মুখে স্বাদ জোগানো অদ্বিতীয় ব্র্যান্ড।

 

এই সাফল্যের রহস্য? উৎপাদনের গুণমান তো বটেই, কুরিয়েন নিজেও সবচেয়ে বেশি জোর দিতেন ওটার ওপরে। সেই সঙ্গে ছিল অনবদ্য প্রচারকৌশল। পাঁচ দশক পেরিয়ে গেল, সাদার ওপরে লাল ছিট ছিট জামা পরা বাচ্চা মেয়েটা কোনো সেলিব্রিটির মুখ ধার না করেই নিজের জায়গাটা ধরে রেখেছে। কুরিয়েন বিজ্ঞাপন সংস্থাকেও পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যে! ‘আটারলি বাটারলি ডিলিশিয়াস আমুল’-এর মতো স্লোগান গোড়ায় তার নিজের কিছুটা কিম্ভূত ঠেকেছিল বটে! কিন্তু বাধা দেননি! ‘আমুল’ বিজ্ঞাপনের ৫০ বছর পূর্তির স্মারকগ্রন্থে কুরিয়েন নিজে লিখেছেন, ‘পিছনে তাকিয়ে বুঝি, স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা ঠিক ছিল!’

 

মার্টিন লুথার কিং থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কুরিয়েন তার আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন, ‘আই টু হ্যাড আ ড্রিম’। কুরিয়েনের জীবন শুধু স্বপ্নকে সত্যি করা নয়, স্বপ্নকে ক্রমাগত ছাড়িয়ে যাওয়ার আখ্যান।

 

মজার ব্যাপার, চলচ্চিত্রেও সমবায় প্রয়াসের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন কুরিয়েন! তার নেতৃত্বে ‘অপারেশন ফ্লাড’-এর চমকপ্রদ কাহিনি নিয়ে শ্যাম বেনেগাল তৈরি করেন বিখ্যাত ছবি, মন্থন (১৯৭৬)। গল্পটা লিখতে সাহায্য করেন কুরিয়েন নিজেই। ছবির খরচ জোগান, যাদের নিয়ে গল্প, তারাই। গুজরাট সমবায় প্রকল্পের পাঁচ লক্ষ দুধ উৎপাদক দুই টাকা করে চাঁদা দিলেন। গিরিশ কারনাড-স্মিতা পাতিলকে নিয়ে তৈরি হলো মন্থন। পরে ‘আমুলে’র বিজ্ঞাপনেও বেজেছে সেই গান, ‘মেরো গাম কথা পারে ঝা দুধ কি নদিয়া বাহে...।’

 

দুধ বিপ্লবেরই তো আর এক নাম কুরিয়েন। ‘আমুল’-এর বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ আজ আড়াই শ কোটি রুপি! অথচ নিজে বলতেন, ‘দুধ একদম খাই না।’ কুরিয়েন বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, উন্নয়নের হাতিয়ারকে মানুষের হাতে তুলে দেওয়া। জীবনের শেষ অঙ্কে নিজের হাতে গড়া কর্মীদের চাপেই নিজের হাতে গড়া সমবায় থেকে সরতে বাধ্য হয়েছিলেন।

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ নভেম্বর ২০১৫/ টিপু