সাতসতেরো

মধুর স্টল, টি-স্টল, রেস্তোরাঁ থেকে মধুর ক্যান্টিন

আবু বকর ইয়ামিন : ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র- সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস, সবকিছুর নীরব সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভবনটির অবস্থান। এখান থেকেই শুরু বাংলাদেশের রাজনীতির চর্চা। মূলধারার রাজনীতির কথা উল্লেখ করতে গেলে প্রথমেই মানসপটে ভেসে আসে এই ভবনের কথা। ভবনটি ‘মধুর ক্যান্টিন’ নামে সমধিক পরিচিত।

 

জরাজীর্ণ দেয়াল, ভাঙা চেয়ার, টেবিল- আজকের মধুর ক্যান্টিনের সব কিছুতেই রয়েছে স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাসের স্পর্শ। মধুর স্টল, মধুর টি-স্টল, মধুর রেস্তোরাঁ থেকে কালক্রমে প্রতিষ্ঠিত মধুর ক্যান্টিন নামটিই যেন একটি ইতিহাস। মধুর ক্যান্টিনের সেই গৌরবজ্জল ইতিহাস আজ অনেকটাই মলিন। এর পেছনের অন্যতম কারণ গত কয়েক দশকের প্রতিহিংসার রাজনীতি।

 

বাঙালির স্বাধীকার অর্জনের ইতিহাস থেকে মধুর ক্যান্টিনকে আলাদা করা কঠিন। নিজস্ব ভূ-খণ্ডের  সামাজিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ক্যান্টিনের স্বত্বাধিকারী মধুদা। উনিশ শতকের প্রথম দিকে বিক্রমপুরের শ্রীনগরের জমিদারদের সঙ্গে মধুদার পিতামহ নকরীচন্দ্রের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ব্যবসা প্রসারের উদ্দেশ্যে নকরীচন্দ্র তার দুই ছেলে আদিত্যচন্দ্র ও নিবারণ চন্দ্রসহ ঢাকায় আসেন। তারা জমিদার বাবুর জিন্দাবাজার লেনের বাসায় আশ্রয় নেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর নকরীচন্দ্র পুত্র আদিত্যচন্দ্রের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যবসা প্রসারের দায়িত্ব দেন।

 

নকরীচন্দ্রের মৃত্যুর পর আদিত্যচন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের মাধ্যমে তার ব্যবসা শুরু করেন। ব্রিটিশ পুলিশ এ সময় ক্যাম্পাসের আশপাশের ব্যারাক ও ক্যাম্প প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নিলে আদিত্যচন্দ্র ব্রিটিশ পুলিশের কাছ থেকে ৩০ টাকার বিনিময়ে দুটি ছনের ঘর ক্রয় করে তার একটিতে বসবাস শুরু করেন। মধুদা তখন ১৫ বছরের তরুণ। তিনি ১৯৩৪-৩৫ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিতা আদিত্যচন্দ্রের সঙ্গে খাবারের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে পক্ষাঘাতে পিতার মৃত্যুর পর মধুদা ব্যবসার হাল ধরেন। পাশাপাশি তার বড় ভাই নারায়ণচন্দ্রের পড়াশোনার খরচ জোগাতে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডাকসু কার্যক্রম শুরু হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের পাশে মধুদার দায়িত্বে ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠিত হয়।

   

‘মধুর ক্যান্টিন’ নামটি কিন্তু শুরুতে ছিল না। প্রতিষ্ঠিত হবার আগে এর নাম ‘মধুর স্টল’, ‘মধুর টি-স্টল’, ‘মধুর রেস্তোরাঁ’ ইত্যাদি ছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন মধুদা, তার স্ত্রী, বড় ছেলে এবং তার নববিবাহিত স্ত্রী। কিন্তু তার মৃত্যুতে থেমে থাকেনি মধুর ক্যান্টিনের কর্মকাণ্ড। ছোট্ট একটি চায়ের দোকান কালক্রমে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ষাটের দশকের কবি, ছাত্রনেতা বুলবুল খান ‘মধুর ক্যান্টিন’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘উনিশশ বাষট্টির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইউক্যালিপটাস এভিনিউ-এর ধার ঘেঁষে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গ্রাস থেকে কোনো রকমে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা বিশাল বিল্ডিংয়ের পূর্বদিকের অংশ তখন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভবন। ছোট মাঠের দক্ষিণ আর পুবে টিনশেড পাকা দেয়ালের অতিরিক্ত কিছু ঘরেও ক্লাস হতো। মাঠের দক্ষিণ কোণে ডোবার চেয়ে কিছুটা বড় সাইজের একটি পুকুর, মাঠের মাঝামাঝি বিখ্যাত আমগাছ, তার পুবে বেলগাছ। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যে অংশটুকু বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হয় তার উত্তর পাশের রাস্তা ঘেঁষে ছিল মধুর ক্যান্টিন।’

 

এক সময় মধুর ক্যান্টিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে স্থানান্তরিত হয় নীলক্ষেত এলাকায়। পেছনে পড়ে থাকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অজস্র স্মৃতিবিজড়িত পুরানো বিশ্ববিদ্যালয় ভবন, একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিবিজড়িত সেই ফটক, আমতলা, প্রথম মধুর ক্যান্টিনের টিনশেড আর ডাকসু কার্যালয়। মধুর ক্যান্টিন এবং মধুদা সম্পর্কে তার ছেলে অরুণ কুমার দে বলেন, ‘বর্তমান বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে যারা বিবেচিত তাদের প্রায় সকলেই আড্ডা দিতেন মধুর ক্যান্টিনে। ত্রিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে রক্ষণশীল পরিসরে দোতলা থেকে চায়ের অর্ডার দেয়া হতো তৃতীয় কোনো মাধ্যমে। বাবা সে সময়ও ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে চা-পান করতে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু বর্তমান পেক্ষাপট ভিন্ন। মেয়েদের কমনরুম থেকে শিক্ষকদের প্রহরায় ক্লাসে নিয়ে যাবার দিন শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। মেয়েরা এখন শুধু মধুর ক্যান্টিনই নয়, ক্যাম্পাস জুড়েও নিঃসঙ্কোচে আড্ডা দিতে পারে তারা।’

 

ত্রিশ ও চল্লিশের দশক থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার ছিল মধুর ক্যান্টিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা পেশ করার ভেতর দিয়ে যে রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয় তার সঙ্গেও এর নাম যুক্ত ছিল। সেই অগ্নিঝড়া সময়ে ছাত্র আন্দোলনের সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হতো মধুর ক্যান্টিন থেকেই। অরুণ দে বলেন, ‘৬৬-এর ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালনের প্রস্তুতি হিসেবে মধুর ক্যান্টিনে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এক সভায় মিলিত হন। এই ক্যান্টিনে গভীর রাতে গোপন বৈঠক হয়। বাবার সাহায্য ছাড়া সেদিন এই বৈঠক করা সম্ভব ছিল না। এ রকম বহু গোপন বৈঠক এই ক্যান্টিনে হয়েছে।  বৈঠকের কথা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়া শুধুমাত্র বাবা অবহিত থাকতেন। তিনি সবার খাবারের ব্যবস্থা করতেন। মধুর ক্যান্টিন ছিল প্রগতিবাদী গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের অলিখিত হেড কোয়ার্টার।’

 

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শরিফ মিয়ার ক্যান্টিন, বলাইয়ের ক্যান্টিন, সায়েন্স ক্যাফেটেরিয়া, টিএসসি ক্যাফেটেরিয়াসহ অনেক স্টল ছিল। কিন্তু মধুর ক্যান্টিন-এর ঐতিহ্য কেউই অতিক্রম করতে পারেনি। উদীয়মান সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, সঙ্গীতশিল্পী, শিক্ষাবিদ, ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক কর্মী এবং আড্ডাবাজ ছাত্রদের ঠিকানা ছিল মধুর ক্যান্টিন। মধুদা নেই কিন্তু তার ক্যান্টিন আজও বাঙালির অস্তিত্বের অখণ্ড ইতিহাস। তবে মধুর ক্যান্টিনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন অরুণ কুমার দে।  তিনি বলেন, ‘গত কয়েক দশকে মধুর ক্যান্টিনে আগের মতো আড্ডা আর সুশৃঙ্খল রাজনীতির চর্চা দেখা যায় না। দিন দিন লোপ পাচ্ছে মধুর ঐতিহ্য। ছাত্ররা দিন দিন আত্মকেন্দ্রীক হয়ে যাচ্ছে।’ এ প্রসঙ্গে ঢাবি’র ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এক সময় মধুর ক্যান্টিনে স্বচ্ছ রাজনীতির চর্চা হতো। ছাত্র রাজনীতিতে এখন স্বচ্ছতার লেশমাত্রও নেই। চারদিকে চলছে হানাহানি। আসলে সত্যি কথা বলতে কি এখন প্রকৃত ছাত্রও নেই। প্রকৃত রাজনীতিও নেই। এটাই সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।’

   

ক্যান্টিনের সংস্কার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগও লক্ষ্য করা যায় না। এ প্রসঙ্গে হতাশা প্রকাশ করে অরুণ দে বলেন, ‘অনেক আগে আমি ক্যান্টিনের সংস্কারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেছি। এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাই নি।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘মধুর ক্যান্টিনের ঐতিহ্য রক্ষায় আমরা সর্বদা সচেষ্ট। কিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অতি দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।’

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ নভেম্বর ২০১৫/তারা