শাহ মতিন টিপু : ‘ও দুনিয়াকে রাখোয়ালে’। বৈজু বাওরা ছবির এই গানটি তো রাতারাতি মহাতারকা বানিয়ে দেয় রফিকে। আর এই গানটির জনপ্রিয়তার ফলে দুটো ঘটনা ঘটল। প্রথমত, দেখা গেল- যে প্রায় সব ছবিতে ‘দুনিয়াকে রাখোয়ালে’র মতো চড়া সুরের একটা গান রাখাটা নিয়মে দাঁড়াল। দ্বিতীয়ত, নওশাদ-রফি জুটিটা স্থায়ী রূপ নিলো।
আসলে রফি জনপ্রিয় হয়ে ওঠা শুরু সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ আলীর সঙ্গে কাজ শুরুর পর থেকে। নওশাদের সুর, শাকিল বাদায়উনির কথা আর রফির কণ্ঠের মিলিত কিছু প্রয়াস সে যুগে অসম্ভব লোকপ্রিয়তা পেয়েছে। এর মধ্যে নওশাদ সাহেবের একটা সমালোচনা ছিল, রফি ছাড়া আর কোনো পুরুষ শিল্পীকে তিনি নেন না। এ সমালোচনাও নওশাদজীর রফি নির্ভরতা চুল পরিমাণ কমাতে পারেনি। দেশবিভাগের পর দুজনই ঠিক করেন, ভারতে থেকে যাবেন, জন্মভূমি পাকিস্তানে যাবেন না। রফির মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের জুটি ভাঙার প্রশ্নও ওঠেনি।
হিন্দি সিনেমার একটা সময় ছিল- মাতালের মুখের গান মানেই মহম্মদ রফি। আর প্রেমের গান? শ্রোতারা সেই সব গান আজও শোনেন। কোনো একটা গান নয়, তার সব গানই শ্রেষ্ঠ। অনায়াসে উঁচু সপ্তকে সুর খেলাতে পারতেন মহম্মদ রফি। ‘ও দুনিয়াকে রাখওয়ালে’, ‘কোই সাগর দিল যো বহলাতা নেহি’ আজও এসব গান লা জবাব।
দীর্ঘ ৩৫ বছরের কেরিয়ারে শচীন দেব বর্মন, সলিল চৌধুরী, শঙ্কর-জয়কিষেণ, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, ও পি নাইয়ার প্রায় সব বড় বড় সঙ্গীত পরিচালকদের সঙ্গেই কাজ করেছেন রফি। লতা, আশা ভোঁসলের সঙ্গে মহম্মদ রফির অনেক গানই অমর হয়ে আছে।
মহম্মদ রফিকে সঙ্গীত পরিচালক নওসাদ আলি বলতেন ভারতের আধুনিক তানসেন। মান্না দে বলেছিলেন, ‘রফির মতো গায়ক ভারতবর্ষ আর পায়নি।’ উপমহাদেশ সেরা এই কিংবদন্তী প্লে-ব্যাক গায়কের জন্মদিন আজ। ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর অমৃতসরে জন্ম তার।
মহম্মদ রফির ছদ্মনাম ‘ফেকো’। অমৃতসরের কাছে যে গ্রামটিতে জন্ম মহম্মদ রফির, সেখানে এক ফকির আসতেন, তাঁর কণ্ঠের আশ্চর্য জাদুতে প্রাণিত হন রফি। তার মৃত্যু ১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই। মাত্র ছাপ্পান্ন বছরের জীবনেই গায়ক হিসেবে হিন্দি ছবির প্লেব্যাক গায়ক হিসেবে এখনও তার সেরার শিরোপা।
মহম্মদ রফির শুরুটা বলতে গেলে এই গল্পটি বলতেই হয়। ঘটনাটি লাহোরের। স্টেজ প্রোগ্রাম। গান গাইবেন সায়গল। তখন সায়গল মানেই সুপারহিট। যার চেহারা আর গানের জন্য সবাই দিওয়ানা। লোকে গিজগিজ করছে। হিন্দি ছবির নায়ক-গায়ককে কাছ থেকে দেখতে, তার গান শুনতে ১২/১৩ বছরের এক কিশোরও এসেছে বড় ভাইয়ের হাত ধরে। সবার মাঝে অপেক্ষার উৎকণ্ঠা। শুরু হবে কখন? ‘এক্ষুনি শুরু হচ্ছে অনুষ্ঠান’ ঘোষণাটা হতেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট! মাইক অচল। অনুষ্ঠান পন্ড হওয়ার উপক্রম। হাজার অনুরোধ-উপরোধেও সায়গল গাইছেন না। অগত্যা লোকজনকে বসিয়ে রাখার জন্য ডাক পড়ল শ্রোতাদের ভিড়ে উপস্থিত স্থানীয় শিল্পীদের। সুযোগ পেয়ে ছুটে গেল এক কিশোর। কয়েকটি গান গেয়ে দিলো নির্ভয়ে। সায়গল সস্নেহে কাছে ডেকে জানতে চাইলেন, ‘তোমার নাম কী?’ ছেলেটি বলল, ‘মহম্মদ রফি’।
লাহোরের মানুষের কাছে রফি সেদিন থেকেই তারকা। অথচ তখনো উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খাঁ আর বড়ে গোলাম আলী খাঁর কাছে ক্লাসিক্যালের তালিম শেষ করতে অনেক বাকি। বড় হওয়ার আগেই কোথাও কোথাও বড় শিল্পীর মর্যাদা পেতে শুরু করায় রফির ভালো তো লাগতোই, লজ্জাও লাগতো ভীষণ।
সায়গলের আসরে বাজিমাৎ করার পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্লেব্যাক গায়ক হওয়ার সুযোগ এসে যায় মাত্র ১৭ বছর বয়সে। মুম্বাইতে তার প্রথম ছবি ‘গাও কী গোরি’ (১৯৪২)। তারপর বলিউডের সেরা পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক হতে আর বেশি সময় লাগেনি। অবশ্য তখনো সায়গল গেয়ে চলেছেন দাপটে।
কী গাননি মোহাম্মদ রফি? হিন্দি গানের কোনো শ্রোতাই তার গানের ভুবন ঘুরে এসে বলতে পারবেন না, ‘কই আমার জন্য কিছুই তো গাননি?’ হ্যায় না বোলো বোলো, চাক্কে মে চাক্কা, রে মামা রে মামা রে, ছু ছু কারতি বা নানহে মুনহে বাচ্চে এমন গান বাচ্চা প্রবীণ সবাইকেই স্পর্শ করে।
দেশের গান শুনবেন? অ্যায় ওয়াতান কে ওয়াতান, হাম লায়ে হ্যায় তুফান, আব তুমহারে হাওয়ালে, ইয়ে দেশ হ্যায় বীর, আপনি আযাদী কো হাম বা হিন্দুস্তান কি কসম-এর মতো অসংখ্য গান।
বিয়ের গান খুঁজতে গেলে চালো রে ডোলি উঠাও, মেরা ইয়ার বানা হ্যায়, আজ মেরে ইয়ারকে শাদি হ্যায়, তেরি রবনে বানাদি বা বাবুল কি দুয়ায়ে লেতি, যা শুনে মুগ্ধ হবেন যে কেউ। আছে বন্ধুর জন্য, বন্ধুত্বের জন্য গান দুনিয়া ছোটে ইয়ার, বাড়ি দুরসে আয়ে হ্যায়, বড়ে মিয়া দিওয়ানে, মেরি দোস্তি মেরা পেয়ার, এক রাস্তা দো রাহি ইত্যদি।
মহম্মদ রফির কাওয়ালিও চিরকাল ভালো লাগার মতো না তো কারাভান কি তালাশ, হাম কিসিসে কম নেহি, পর্দা হ্যায় পর্দা, ম্যায় ইধার যায়ু ইয়া, ইয়ে হ্যায় ইশ্ক ইশ্ক, রাজ কি বাতৃ ইত্যাদি। রফির এমন গানও আছে যা শুনে ধার্মিকেরা উপাসনার কাজ কিছুটা সেরে নিতে পারেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মনিবেদনের গানগুলোর মাঝে সবার আগে বলতে হবে ও দুনিয়াকে রাখোয়ালে, ইয়া নবি সালামালাইকা, বৃন্দাবনকা কৃষ্ণা, মন তরপাত হরিদর্শন, বড়ি দের ভাই নন্দলালা এবং মেরি বিনতি সুনো ভাগোয়ান-এর কথা।
আবার রফির ক্লাসিক্যাল গান যেমন মনরে তু কাহে, সাওন আয়ে না আয়ে, নাচে মন মোরা মগন বা মধুবনমে রাধিকা নাচেরে। হিন্দি লোকগীতি আরো অসাধারণ হয়ে ওঠে রফির কণ্ঠে ন্যায়েন লড় যাইহে, পিপড় কে পাতওয়া, গোভিন্দ আলারে আলা, দুখ ভারে দিন বিতে, সে রকম কিছু গানেরই উদাহরণ।
তবে কাওয়ালি, আধ্যাত্মিক, দেশাত্ববোধক, ক্লাসিক্যাল, লোকগীতি, ছোটদের বা বিয়ের যে গানের কথাই বলি না কেন, সাধারণত জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যায় আবেগকে নাড়া দেয়া রোমান্টিক গান। তেমন গানের শ্রোতাদের জন্য রফি রেখে গেছেন ইয়ে মেরা প্রেমপত্র, রাহা গার্দিশোমে হারদম, খিলোনা জানকার, আপ আয়ে বাহার আয়ি, কেয়াসে কেয়া হো গ্যায়া, দিলকে ঝড়োকেমে তুঝকো বিঠাকার, ইয়াদ না যায়ে বিতে দিনোকি, বাহারো ফুল বরসায়ো, ছু লেনে দো নাজুক, না ঝটকো জুলফসে পানি, খিলোনা জানকার তুম, দিন ঢল যায়ে হায়, টুটে হুয়ে খাবোনে, কাভি খুদপে, হাম তুম সে জুদা হোকে, তেরি পেয়ারি পেয়ারি সুরতকো, আনেসে উসকে আয়ে বাহার, চান্দ মেরা দিল, পুকারতা চলা হু ম্যায়, চওদভিঁকা চান্দ, মেরে মেহবুব তুঝে, ইয়ে রেশমি জুলফে।
রফির সেরা সময়ে নায়করাও শর্ত জুড়ে দিতেন, তাদের ছবিতে রফিকে রাখতেই হবে। সমসাময়িক এমন নায়ক খুঁজে বের করা কঠিন যার রফির গানে ঠোঁট মেলানোর সৌভাগ্য হয়নি। গায়ক-নায়ক-পরিচালক কিশোর কুমারকে পর্যন্ত রফির গান গাওয়ার অভিনয় করতে হয়েছে। ষাটের দশকে শাম্মি কাপুরের জন্যে রফি ছাড়া অন্য কাউকে গাইতে দেখা ছিল অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। দিলীপ কুমার, রাজেন্দ্র কুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্র বা শশি কাপুরদেরও খুব কমই দেখা যেতো অন্য শিল্পীদের গানে ঠোঁট মেলাতে।
৩৫ বছরের সঙ্গীত জীবনে ২৬ হাজারের মতো গান গেয়ে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে যৌথভাবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছেন মোহাম্মদ রফি। এত বিশাল ভান্ডার থেকে কয়টা গানের কথা বলবেন?
গান্ধিজীর প্রয়াণের পরপরই তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রফির গাওয়া একটা গান বাজারে এলে ‘সুনো সুনো অ্যায় দুনিয়াওয়ালো, বাপুকি অমর কাহানি’(১৯৪৮) সে গান শুনে জওহর লাল নেহেরু কেঁদে ফেলেছিলেন।
পাঞ্জাবি, মারাঠি, সিন্ধি, গুজরাটি, তেলেগু, বলতে গেলে ভারতের সব ভাষাতেই গান গেয়েছেন মোহাম্মদ রফি। গেয়েছেন ইংরেজীতেও। শুধু শিল্পী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও মোহাম্মদ রফি ছিলেন অসাধারণ।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ডিসেম্বর ২০১৫/টিপু