সাতসতেরো

বিয়ের আংটির নেপথ্য ইতিহাস

শামীমা নাসরিন রিপা : শুরু হয়ে গেছে বিয়ের মৌসুম। অন্যান্য ঋতুর চেয়ে শীতকালে আমাদের দেশে বিয়ে একটু বেশিই হয়। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিয়ে বা বাগদানে আংটি বদলের রীতি প্রচলিত রয়েছে। অগণিত যুগলদের কাছে গভীর ভালোবাসা আর আবেগের প্রতীক হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে আংটির ব্যবহার। এর পেছনের ইতিহাস, আংটি কী অর্থ প্রকাশ করে আর কেনই বা অনামিকায় আংটি পরার রীতির প্রচলন হল তা নিয়েই আজকের আয়োজন।

 

আংটির প্রথম ব্যবহার : জানা যায়, প্রায় ৪ হাজার ৮০০ বছর আগে মিশরীয়রা সর্বপ্রথম আংটির ব্যবহার শুরু করে। তারা তখন ‘প্যাপিরাস’ গাছের পাতা আর বাকল পেঁচিয়ে গহনা হিসেবে আঙ্গুলে পড়তো। মিশরীয়দের কাছে এর বিশেষ মর্মার্থ ছিল। আংটির বৃত্তাকার পেঁচটি সম্পর্কের অমরত্ম প্রকাশ করত। তারা এমন সম্পর্ককে বোঝাতো- যার আদি এবং অন্ত নেই।

 

মাঝখানের খালি জায়গাটারও রয়েছে আলাদা অর্থ। এই খোলা জায়গাকে তারা একটি খোলা দরজা হিসেবে দেখত। যে আংটি পড়াবে এবং যাকে পড়ানো হবে তাদের মধ্যে থাকবে না কোনো অজানা আর অচেনা বিষয়। এই খোলা দরজা দিয়ে দুজনের মনের মিল ঘটবে। একজন নারীকে এই আংটি দেয়ার অর্থ ছিল- তার প্রতি গভীর এবং অমর ভালোবাসা প্রকাশ করা।

 

কিন্তু প্রেমিক যুগলের ভালোবাসার স্থায়ীত্বের কাছে পাতা আর বাকলের তৈরি আংটি ফিকে লাগছিল। তাই আংটি তৈরিতে বিভিন্ন উপাদানের ব্যবহার শুরু হল। যেমন- চামড়া, হাড়, হাতীর দাঁত ইত্যাদি। যে যত স্থায়ীত্ব সম্বলিত আংটি দিত তার ভালোবাসা ততো স্থায়ী- এমন একটি ধারণার শুরু হয়েছিল।

 

অধিকার প্রকাশে আংটির ব্যবহার : শুধু মিশরীয় সংস্কৃতিতেই নয়, ভালোবাসার মানুষকে আংটি পড়ানোর রীতি ছড়িয়ে পড়েছিল আরো অনেক সংস্কৃতিতেও। মিশরীয়দের কাছ থেকে রোমানরাও শিখেছিল আংটির ব্যবহার। তবে রোমানরা মিশরীয়দের থেকে একটু ভিন্নভাবে গ্রহণ করেছিল আংটিকে। আংটি প্রদানের মধ্য দিয়ে রোমান পুরুষরা প্রেমের বহিঃপ্রকাশের সাথে সাথে প্রকাশ করত ব্যক্তি মালিকানাও। অর্থাৎ কোনো নারীকে আংটি প্রদানের মাধ্যমে তারা সেই নারীর উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করত।

 

রোমানরা বিয়েতে ব্যবহার করত লোহার তৈরি আংটি। যা শক্তি ও স্থায়ীত্বের প্রতীক ছিল। একে বলা হত ‘Anulus Pronubus’ (অ্যানুলাস প্রোনুবাস)। ধারণা করা হয় রোমানরাই সর্বপ্রথম আংটিতে খোদাই করে নকশা করেছিল।

 

খ্রিষ্টানদের মধ্যে আংটির ব্যবহার : ৮৬০ সালের পূর্বেই খ্রিষ্টানদের মধ্যে ব্যবহার শুরু হয় আংটির। তারা বিয়েতে আংটি বদল করত। তাদের আংটিগুলোতে বিভিন্ন ধরণের নকশা আঁকা থাকত। সে সময় কয়েক স্তর বিশিষ্ট আংটির ব্যবহারও দেখা যেত। কোনো কোনো আংটিতে দুটি সংযুক্ত হাতের নকশা আঁকা থাকত। কিন্তু বিশপ এর নির্দেশে এসব আংটির ব্যবহার বন্ধ হয়। আর তৈরি হয় খুব সাধারণ কিছু আংটি, যা দেখলেই পবিত্র আর আধ্যাত্মিক অনুভূতি হত। তখনকার বিশপেরা এই নতুন নকশার আংটিকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘দুটি হৃদয়ের বন্ধনের প্রতীক’।

 

অনামিকাতে আংটি পরার রেওয়াজ যেভাবে : ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বাম হাত ও ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলসহ বিভিন্ন আঙ্গুলে আংটির ব্যবহার হত। বাম হাতের অনামিকায় আংটি পড়ার প্রচলনটি এসেছিল রোমানদের কাছ থেকে। কারণ, তারা বিশ্বাস করত বাম হাতের অনামিকার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ছিল হৃদয়ের একটি শিরার। তাই এই শিরাটিকে তারা বলত ‘Vena Amoris’ অর্থাৎ ভালোবাসার শিরা। যদিও পরবর্তীতে গবেষণায় এই তথ্যটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

 

বাম হাতের অনামিকায় আংটি পড়ার রীতি নিয়ে আরো একটি মতবাদ প্রচলিত আছে। অনেকের মতে এই রীতিটি এসেছে খ্রিস্টানদের কাছ থেকে। খ্রিস্টানরা তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে পরম পিতা, পুত্র, পবিত্র আত্মাকে স্মরণ করত। বিশপ যখন এই তিন নামের উল্লেখ করতেন, তখন বর স্পর্শ করত কনের তিনটি আঙ্গুল- বৃদ্ধা, তর্জনি আর মধ্যমা। সর্বশেষে বিশপ যখন ‘আমেন’ (তথাস্তু) বলতেন তখন বর কনের অনামিকায় পড়িয়ে দিত বিয়ের আংটিটি। এভাবেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হত।

 

তবে এই রীতির প্রচলনের পেছনে বাস্তব সম্মত একটি কারণ হল- বাম হাতের অনামিকায় আংটি পরিধান করলে দৈনন্দিন কাজকর্মে তা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জানুয়ারি ২০১৬/রিপা/আমিনুল