সাতসতেরো

সারসাপারিলা পানীয় ও কুমারী লতা

আজহারুল ইসলাম : কুমারী লতা উদ্ভিদের এই নাম কেন হলো তা নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছে করছে। সুধী পাঠক, সেটি উল্লেখ করবো এই লেখার এক অংশে। তার আগে এই উদ্ভিদের অন্যান্য দিক তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

 

উদ্ভিদ বিজ্ঞানের ভাষায় একে Smilax Sp বলা হয়। এই জেনাসের প্রায় ৩০০-৩৫০টি প্রজাতি আছে। এদেরকে সাধারণত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এরা Smilacaceae পরিবারভুক্ত একবীজপত্রি সপুস্পক কাটা যুক্ত climbing পেরিনিয়াল শক্ত কাস্টল লতা জাতীয় উদ্ভিদ। ইংরেজীতে এদেরকে ওয়াইল্ড সারসাপারিলা, ইন্ডিয়ান সারসাপারিলা বা ব্ল্যাক ক্রিপার বলা হয়। এছাড়াও Catbriers, Greenbriers, Prickly-ivys I smilax নামে পরিচিত। আমাদের দেশে কুমারীলতা বা কুমারীকা নামেই অধিক পরিচিত। তবে কোথাও কোথাও বুলকুমিয়া, বেড়াল আচড়া নামেও এই উদ্ভিদ পরিচিতি লাভ করেছে।

 

লেখার শুরুতেই বলেছি কুমারীলতা শক্ত লতানো, কাঁটাযুক্ত আরোহী উদ্ভিদ। পাতার অগ্রভাগ সরু, বৃন্তদেশ গোলাকার, পাতার উপরের দিক মসৃণ। গ্রীষ্ম, বর্ষায় মনকাড়া ফুল ফোটে। এর কচি ডগার রঙ খুবই আকর্ষনীয়। দেখলে মনে হয় যেন সদ্যস্নাত এক রূপসী তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। আগেকার দিনে অবিবাহিত মেয়েদের PMS এর ব্যাথা নিরাময়ে এই লতার কচি ডগা পিষে রস খাওয়ানো হতো। এতে যেহেতু চমৎকার ফলাফল পাওয়া যেতো তাই এর বাংলা নামকরণ করা হয় ‘কুমারীলতা’ বা ‘কুমারিকা’।

   

বর্তমানে sarsaparilla বিয়ার হিসেবে পান করা হয়। এর অল্প করেকটি ব্র্যান্ড আমেরিকাতে পাওয়া যায়। আগে এই পানীয় প্রচুর পাওয়া যেতো কিন্তু এখন আর সব দেশে পাওয়া যায় না। এখন sarsaparilla ফ্লেভারের ড্রিংকস পাওয়া যায় তাতে Smilex Sp ব্যবহার করা হয় না। বলা যায় আসল sarsaparilla এখন খুব কম প্রস্তুত করা হয়।

 

১৮২০ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত কুমারী লতা USP তে সিফিলিসের ঔষধ হিসেবে রেজিস্টার্ড ছিলো। কুমারীলতায় স্যাপোনিন, রেসিন, ডায়োসজেনিন, ট্যানিন, সিটোস্টেরল, কিউমারিন, রুটিন, স্মাইলাসপারিক এসিডসহ বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান রয়েছে যা এর মূল থেকে পৃথক করা হয়। এই উপক্ষারগুলো সিফিলিস, গনোরিয়া, বাত, পায়ের ব্যথা, ফুলে যাওয়া, রক্ত-শুন্যতা, আমাশয় ও জ্বরের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এর রাইজোম শুকিয়ে পাউডার করে বাতের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। জ্যামাইকান কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যাতে ৪ রকমের Progesterone থাকে। এক সমীক্ষায় দেখা যায় Smilax flavonoids অটোইমিউনি (autoimmune) ডিজিজে ভাল ফল পাওয়া যায়। ২০০৬ ও ২০০৮ সালে আমেরিকার কিছু গবেষক যথাক্রমে দাবি করেছেন Smilax-এর রাইজোম লিভার ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ও এন্টি ভাইরাল ফলাফল প্রদর্শন করে। তবে এই নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

 

Smilax প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। আগুনে পুড়িয়ে দিলেও এর রাইজোম থেকে পুনরায় নতুন উদ্ভিদের জন্ম হয়। পাখি ও অন্য ছোট জীব জন্তু এর পরাগায়ন ঘটায় ও বীজের বিস্তার ঘটায় ফলে নতুন উদ্ভিদের জন্ম নেয়। সাধারণত কুমারীলতা অন্য উদ্ভিদের উপর কাটা ও আকর্ষির সাহায্যে ভর করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে।

 

নোটঃ* PMS=প্রি-মিন্সস্ট্রুয়াল সিনড্রোম।* USP=ইউনাইটেড স্টেটস ফার্মাকোপিয়া।* Progesterone=Progesterone (প্রোজেস্টেরন) এক প্রকার হরমোন যা মেয়েদের ওভারিতে উৎপন্ন হয় এবং প্রেগনেন্সিতে সহায়তা করে।* ফ্ল্যাভোনয়েড=ফ্ল্যাভোনয়েড (Flavonoids) হলো উদ্ভিদের খুবই গুরুত্ববাহী রঞ্জক (Pigment) যা ফুলের রঙ তৈরি করে, পরাগায়নকারী প্রাণিদের আকৃষ্ট করার জন্য ফ্লাভোনয়েড হলুদ, লাল ও নীল রঙের পাপড়ির ডিজাইন তৈরি করে। কিছু উঁচু (Higher plants) শ্রেণির উদ্ভিদে ফ্ল্যাভোনয়েড UV (আল্ট্রা ভায়োলেট) রেডিয়েশনকে ফিলট্রেশন করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও ফ্ল্যাভোনয়েড উদ্ভিদের রাসায়নিক মেসেঞ্জার, শারীরবৃত্তীয় নিয়ন্ত্রক এবং সেল (Cell) চক্র ইনহিবিটরের কাজ করতে পারে।* Venereal disease = এক ধরনের রোগ যা যৌন সঙ্গমের ফলে উৎপন্ন বীর্য (semen) অথবা ভেজাইনাল ফ্লুইড নিঃসরনের মাধ্যমে ছড়ায়।

 

লেখক : উদ্ভিদবিদ।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/হাসনাত/শাহনেওয়াজ