সাতসতেরো

এখানেই হয়েছিল ‘চন্দ্রকথা’র চিত্রায়ণ

শেখ মহিউদ্দিন আহাম্মদময়মনসিংহ,  ২৮ সেপ্টেম্বর : সাহিত্য সংস্কৃতি ও শিল্পকলায় সমৃদ্ধ ময়মনসিংহ। এই ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অন্যতম একটি জনপদের নাম আঠারবাড়ি। এখানে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘আঠারবাড়ি জমিদার বাড়ি’। জমিদার বাড়ির সম্মুখ দিয়ে চলার পথে পথিক এখনও থমকে দাঁড়ায়! কৌতুহলভরা দৃষ্টিতে অবলোকন করে জমিদার বাড়ির স্থাপত্যশৈলী। উপজেলা সদর হতে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পূর্বে বর্তমানে পরিত্যক্ত, দৃষ্টিনন্দন, সুবিশাল জমিদার বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন এখন বিলুপ্তির পথে। অপরূপ স্থাপত্যশৈলী ও চমৎকার কারুকার্যময় এ রাজ বাড়িটির বয়স প্রায় আড়াইশ বছর। জানা যায়, ১৯৭৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মোমেনশাহী (ময়মনসিংহ) পরগনা রাজশাহী কালেক্টরেটের অধীনে ছিল। সে সময় মহারাজ রামকৃষ্ণের জমিদারি খাজনার দায়ে নিলামে উঠলে এ পরগনাটি ‘খাজে আরাতুন’ নামে এক আর্মেনীয় ক্রয় করেন। ১৮২২ খৃষ্টাব্দে আরাতুনের ২ মেয়ে বিবি কেথারিনা, বিবি এজিনা ও তার ২ আত্মীয় স্টিফেন্স ও কেসপার্জ প্রত্যেকে ৪ আনা অংশে এ পরগনার জমিদারি লাভ করেন। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে আঠারবাড়ির জমিদার শম্ভূরায় চৌধুরী, বিবি এজিনার অংশ মতান্তরে কেসপার্জের অংশ ক্রয় করেন।

পরে মুক্তাগাছার জমিদার রামকিশোর চৌধুরীর জমিদারি ঋণের দায়ে নিলামে উঠলে তা শম্ভুরায় চেীধুরীর পুত্র মহিম চন্দ্র রায় চৌধুরী কিনে নেন। জমিদারি প্রতিষ্ঠার পর তাদের আয়ত্বে আসে উত্তরে গৌরীপুরের রাজবাড়ি, পশ্চিমে রামগোপালপুর, ডৌহাখলা দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর ও নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা। তাছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর জেলার বেশ কয়েকটি মৌজা ছিল এ জমিদারের দখলে। প্রতি বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এসব জেলা শহরে স্থাপিত আঠারবাড়ি কাচারি বাড়িতে নায়েব উপস্থিত হয়ে খাজনা আদায় করতেন। আজও এসব কাচারি ‘আঠারবাড়ি বিল্ডিং’ নামে নিজ নিজ জেলায় পরিচিতি পেয়েছে।  জমিদার বংশের উপাধি ‘রায়’ থেকে পরবর্তীতে উপজেলার অন্যতম প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র রায় বাজারের নামকরণ করা হয়। বংশ পরম্পরায় পরবর্তী জমিদার দীপ রায় চৌধুরীর জমিদার পরিবারের দেখাশোনা করার জন্য যশোর থেকে ১৮টি সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার সংগে নিয়ে এসে এখানে তাদের বাড়ি ঘর করে দেন । এই ১৮টি পরিবারের নিবাসকে ঘিরেই এ জায়গাটি আঠারবাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। একশ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত জমিদারবাড়ি, বিশাল পুকুর, পরিখা, পুকুরে নামার জন্য সুড়ঙ্গপথ, বাড়ির দক্ষিণে আর একটি পুকুরে  রাজহাঁস সাঁতার কাটার স্থান, জমিদার পরিবারের বিকালে বসে সে সব দৃশ্য অবলোকনের স্থান, চিড়িয়াখানা, জমিদারের বসতবাড়ির সামনে পূর্বপার্শ্বে  নাটমন্দির ও রঙ্গশালায় প্রতি বছর এখানে পূজা-পার্বন হত।

দূর্গাপুজার সময় নাট্য উৎসব ও আনন্দ ফূর্তি চলত দীর্ঘদিন ধরে। কলকাতা থেকে শিল্পীরা এসে এখানে উৎসবে যোগ দিতেন। জমিদারের ব্যবহার করা বিশাল আকৃতির সিন্দুক, ময়ূর সিংহাসন ও প্রচুর দর্শনীয় মূর্তির এখন আর কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে জমিদার প্রমোদ রায় চৌধুরী পরিবার পরিজন নিয়ে ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আঠারবাড়িতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনকে কেন্দ্র করে আছে নানা গুঞ্জন। তবে একথা সত্য যে আঠারবাড়ির সর্বশেষ জমিদার প্রমোদ রায় চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের ছাত্র থাকার সুবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে রায় পরিবারের একটা ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। আর এ সুবাদেই ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্র“য়ারী সকাল বেলা কবিগুরু আঠারবাড়ি জমিদার বাড়িতে আগমন করেছিলেন। জমিদার বাড়ির কুমার কবিকে আঠারবাড়ি স্টেশন থেকে বিরাট মিছিলসহ রাজবাড়ির নতুন প্রাসাদে নিয়ে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করেন। রবীন্দ্রনাথ এ সময় সোনার চাবি দিয়ে নতুন রাজবাড়ির দ্বার উন্মোচন করেছিলেন। বর্তমানে জমিদার বাড়ির ভগ্নপ্রায় বিশাল অট্টালিকার ধ্বংসস্তুপের মাঝেও অনেকস্থানে চমৎকার নির্মাণশৈলী চোখে পড়ার মত। এখনও সৌন্দর্য পিয়াসী অনেক মানুষ এখানে এসে ভীড় জমান। এঁদের মধ্যে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির কিংবদন্তী জননন্দিত কথা সাহিত্যিক মরহুম ডঃ হুমায়ুন আহমেদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য যে, নুহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে ‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন নাটক জমিদার বাড়ির সুনিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশে চিত্রায়িত হয়েছিল। বর্তমানে আজ জমিদার নেই, জমিদারীও নেই তবু রয়ে গেছে তাদের কর্মকান্ডের নানা কীর্তি।  

 

রাইজিংবিডি / শামটি