সাতসতেরো

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদান অসামান্য

শাহ মতিন টিপু : আজ আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। এইদিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স¥রণ করা হয় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী বিশে¡র সকল দেশের শান্তিরক্ষীদের অসামান্য অবদান। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত শান্তিরক্ষীদের স¥রণে বিশে¡র অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও এই দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করা হয়।

 

বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে অন্যতম শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ১৯৮৮ সাল থেকে অংশ নিয়ে অদ্যাবধি বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী সদস্যরা সর্বোচ্চ পেশাদারী মনোভাব, আনুগত্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। তাদের অনন্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।

 

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশ এখন বিশ্বে সর্বোচ্চ শান্তি সেনা প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনা, নৌ, বিমান ও পুলিশবাহিনী আন্তর্জাতিক মান অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। যে কারণে বাংলাদেশ বীরের জাতি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নারীরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন।

 

দিবসটি উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ আজ শান্তি ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিত। তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সকল সদস্যকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানান । বিশ্বশান্তি রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে সকল শান্তিরক্ষী সদস্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন রাষ্ট্রপতি তাদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।

 

দিবসটি উপলক্ষে প্রদত্ত বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের দৃষ্টান্তমূলক সেবা, কঠোর পরিশ্রম, আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থ মনোভাব ও সাহসিকতা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে শুধু পরিচয়ই করায়নি, বরং দেশের ভাবমূর্তিকেও অনেক উজ্জ্বল করেছে।

 

ইউক্রেনের শান্তিরক্ষী সংস্থা এবং ইউক্রেন সরকারের যৌথ প্রস্তাবনায় ১১ ডিসেম্বর, ২০০২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী এ দিবসের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস প্রথম উদযাপন করা হয়। ১৯৪৮ সালে সংঘটিত আরব-ইসরাইলী যুদ্ধকালীন যুদ্ধবিরতী পর্যবেক্ষণে গঠিত জাতিসংঘ ট্রুস সুপারভিশন অর্গানাইজেশন (আন্টসো) দিনকে উপজীব্য করে ২৯ মে তারিখটি স্থির করা হয়েছে। জাতিসংঘ ট্রুস সুপারভিশন অর্গানাইজেশন (আন্টসো)-ই হচ্ছে প্রথম জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী।

 

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সততা ও আত্মত্যাগের কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি পুরস্কার অর্জন করেছে। সততা, যোগ্যতা, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগের কারণে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সবচেয়ে বেশি শান্তি সেনা পঠিয়ে মর্যাদা কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাতও এটি। বর্তমানে বিশ্বের ১২২টি দেশের শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের ৯৫৯৩ জন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ওইসব দেশের ১৭টি মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত আছেন।

 

বাংলাদেশ গত দুই দশকের অধিক সময়কাল ধরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে আসছে। এর মাধ্যমে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ সেনা প্রদানকারী দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের জন্য গর্বের বিষয়।

 

১৯৮৮ সালে ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। তার পরের বছর, ১৯৮৯ সালে ২৫ জন সেনা ও ৩৪ জন পুলিশ পর্যবেক্ষক ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশন্স অ্যাসিস্ট্যান্স গ্রুপ ইন নামিবিয়া মিশনে প্রেরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার দীর্ঘমেয়াদি অংশগ্রহণের সংকল্প ব্যক্ত করেন। ১৯৯০-৯১ সালে প্রথম আরব উপসাগরীয় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনীতে বাংলাদেশের ২১৯৩ জন সেনা সদস্য অংশগ্রহণ করে। সেটিই ছিল জাতিসংঘের বাইরে কোনো একক দেশের নেতৃত্বে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের প্রথম অংশগ্রহণ। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কম্বোডিয়া মিশনে প্রথমবারের মতো এক ব্যাটালিয়ন সেনা প্রেরণ করে। বাংলাদেশি সেনাদের পেশাদারি দক্ষতা, আন্তরিকতা ও পক্ষপাতশূন্যতা অল্পদিনের মধ্যেই এ দেশকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ মিশনে আরও বেশি মাত্রায় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়।

 

জাতিসংঘ মিশনে প্রথম দশক : ১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি মিশনে অংশ নেয়। কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা, মোজাম্বিক, সোমালিয়া, হাইতি, অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন, কঙ্গো, পূর্ব তিমুর ও সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় পরিচালিত মিশনগুলো এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ১৯৯০-২০০০ স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী প্রথম দশকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মিশনে অংশ নেয়। এগুলো হলো রুয়ান্ডা (অক্টোবর ১৯৯৩-ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪), মোজাম্বিক (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩-ডিসেম্বর ১৯৯৪) এবং সোমালিয়া (জুলাই ১৯৯৩-ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫)।

 

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সিয়েরা লিওনে অবস্থিত জাতিসংঘ মিশনে অংশ নেয়। সিয়েরা লিওনের ভয়ানক পরিস্থিতিতে যখন অনেক রাষ্ট্র মিশন পরিত্যাগ করে দায়িত্বে চরম অবহেলার পরিচয় দেয়, বাংলাদেশ তখন সেখানে অল্প সময়ের নোটিশে এক ব্রিগেড সেনা দক্ষতার সঙ্গে মোতায়েন করে। বাংলাদেশি সেনা ব্রিগেড অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে গেরিলা-নিয়ন্ত্রিত জায়গাগুলো পুনরুদ্ধারে এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের এই ভূমিকায় মুগ্ধ সিয়েরা লিওন সরকার বাংলাকে সে দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০০৩ সালে এক সরকারি সফরে সিয়েরা লিওনের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশে আসেন এবং তার দেশের শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশিদের ভূমিকা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।

 

শান্তিরক্ষা মিশনে দ্বিতীয় দশক : জাতিসংঘ শান্তি মিশনের দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশের অবদান সেনা ও পুলিশ প্রদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে ১০ শতাংশ। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে ৯০ শতাংশ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মিশনগুলোতে কর্মরত এবং এর মধ্যে আইভরি কোস্ট ও লাইবেরিয়ায় সর্বাধিকসংখ্যক বাংলাদেশি সেনা কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বমোট ৪০টি দেশের ৫২টি মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬,৯২১ জন সেনা সদস্য ও সেনাবিশেষজ্ঞ এবং পুলিশ বাহিনীর ১,৮৫১ জন সদস্য জাতিসংঘ পরিচালিত বিভিন্ন শান্তি মিশনে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০০ সাল-পরবর্তী সময়ে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আরো বেড়েছে।

 

১৯৮৯ সালে নামিবিয়ায় পরিচালিত ইউএন ট্রানজিশন অ্যাসিস্ট্যান্স গ্রুপে (ইউএনটিএজি) সদস্য প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ জাতিসংঘ মিশনে তার যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ পুলিশ আইভরি কোস্ট, সুদান, দক্ষিণ সুদান, পূর্ব তিমুর, ডিআর কঙ্গো, হাইতি ইত্যাদি দেশে পরিচালিত মিশনগুলোতে বিশেষজ্ঞ ও ফর্মড পুলিশ ইউনিট (এফপিইউ) উভয় ক্যাটাগরিতে সদস্য প্রেরণ করেছে। বাংলাদেশ এখন অবধি সর্বাধিক বেশি সংখ্যায় নারী পুলিশ সদস্য প্রেরণে সক্ষম হয়েছে এবং তারা দক্ষতার সঙ্গে মিশনগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

২০১০ সালের মে মাসে হাইতিতে বাংলাদেশ থেকে একটি মহিলা ফর্মড পুলিশ ইউনিট (এফপিইউ) প্রেরণ করা হয়। যেকোনো মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীর দেশ থেকে এ ধরনের উদ্যোগ এটাই প্রথম এবং এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ২০১১ সালের মে মাসে একটি নেভি ফ্রিগেট ও একটি বহিঃসমুদ্র পেট্রল নৌযানের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম দলটি জাতিসংঘ পরিচালিত ইন্টেরিম ফোর্সেস ইন লেবানন (ইউএনএফআইএল) মিশনে অংশগ্রহণ করে।

 

২০০৭ সালে জাতিসংঘ স্ট্যান্ডবাই অ্যারেঞ্জমেন্ট সিস্টেমের (ইউএনএসএএস) আওতায় একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের মধ্যে বর্তমান কাঠামোয় সেনা ও পুলিশ সদস্য প্রেরণ করা শুরু হয়। মূলত নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত অনুরোধের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রেরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

 

১৯৯০ সালের প্রথমে পাকিস্তান ও ভারতকে পেছনে ফেলে ইউএন শান্তি রক্ষার কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদানকারীর ভূমিকা পালন করে আসছে বাংলাদেশ।

 

আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস আজ সকালে ‘পিসকীপার্স রান’এর মাধ্যমে এ দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

 

বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) শহীদ শান্তিরক্ষীদের নিকটাত্মীয় এবং শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ঘটনায় আহত শান্তিরক্ষীদের সম্মানে এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছে । এতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বলে আইএসপিআর জানিয়েছে। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ উপস্থাপনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিটিভি ওয়ার্ল্ড সরাসরি সম্প্রচার করবে।

 

মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবর্গ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানগণ, সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও), পুলিশের মহা-পরিদর্শক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গসহ পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তগণের এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৬/টিপু