স্বরলিপি : ‘তার চুড়িতে যে রেখেছি মন সোনা করে/ চুড়িতো জানে না সে নিজে বাজে না/ সে যে আমার হৃদয় বাজে রিনি ঝিনি চুড়িরও স্বরে/।’ শ্রীকান্ত আচার্যের গাওয়া এই গান যে কোনো রোমান্সপ্রিয় মানুষেরই পছন্দ।
চুড়ি বহন করে ঐহিত্য-চুড়ি কখনো কখনো বহন করে সম্পর্ক। গ্রাম-নগর কিংবা শহর কোথাও এই গায়নার জনপ্রিয়তার কমতি নেই। উপহার হিসেবেও চুড়ির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। এতে মিশে আছে আবেগ আছে সীমাবদ্ধতাও। এই গয়নাটি মন চাইলেই কাউকে উপহার দেওয়া যায় না। কোথায় যেন একটা বাঁধা। কারণটা বোধহয় অন্য কোথাও-
হোক না কম দামী কাচের চুড়ি কিন্তু তার রিনি-ঝিনি শব্দের আছে দুর্দান্ত ক্ষমতা। এই শব্দ যে কারো হৃদয় পর্যন্ত বাজিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কেউ কেউ কাচের চুড়িতেই পেয়ে যায়, মূল্যবান সোনার খোঁজ। আক্ষরিক অর্থ না হোক অলিখিতভাবে হয়তো তারও বেশি।
তিনি প্রেমলা। বিয়েতে সোনার গয়না পেয়েছিলেন পাঁচ ভরি। সময় ১৯৮৮। সারা দেশে তখন বন্যা হয়েছে। ঘরে ঘরে অর্থনৈতিক সংকট। নতুন বউয়ের কিছু গয়না তখনই বিক্রি করে দেওয়া হয়। কিন্তু দু হাত ভরে কাচের চুড়ি পরার অভ্যাস ছিল প্রেমলার। লাল-নীল-সাদা-কালো সব রকমের কাচের চুড়ি কিনে এনে দিতেন প্রেমলার বর। পরবর্তীতে সংসারে মানুষ বেড়েছে। অভাবের ঘরে যেন ওই রঙগুলোই রাঙিয়ে তুলেছে, পুরোনো না হওয়া আকাঙ্ক্ষা।
প্রেমলা বরের সঙ্গে নেমেছেন অর্থের খোঁজে। বর মো. বাঁধন মিয়া ফেরি-করে কসমেটিকস বিক্রি করেন। আর প্রেমলা হয়ে উঠেছেন একজন চুড়ি ব্যবসায়ী। চল্লিশোর্ধ্ব এই নারী বরকে নিয়ে রাজধানীর তিব্বতে বসবাস করেন।
প্রেমলার কর্মস্থান শাহবাগ। ছবির হাটে ঢুকতে গেলে, ‘‘স্বাধীনতা স্তম্ভ’ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা। গেইট নং-২’-এর কাছাকাছি ফুটপাতে চুড়ির পসরা বসান প্রেমলা। এই শহরে ফুটপাতে ব্যবসা করতে গেলে যে ধকল সহ্য করতে হয়, তিনিও সেগুলো একটা একটা করে মানিয়ে নিয়েছেন। মাঝে মধ্যে পুলিশের অভিযান চলে। এমন পরিস্থিতিতে কখনো কখনো ভাঙা পড়ে দোকানের সব চুড়ি।
প্রেমলা জানেন, যে কোনো সময় তার দোকানের চুড়ি ভেঙে দিতে পারে। এ তার কাছে অতি সাধারণ ঘটনা। এই ঘটনার মুখোমুখী হওয়ার জন্য, সে যেন সব সময় প্রস্তুত থাকে। নিয়মের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ বুঝি এভাবেই সব মেনে নিতে শিখে।
হোক না সে নিয়ম অন্যায়ের! একবার ভাবুন যৌতুক প্রথার কথা। কে টলাতে পেরেছে এই নিয়ম। নিয়মে পরিবর্তন এসেছে বৈকি! যৌতুক দিতে হয় না, ছেলের ঘর সাজিয়ে দিতে হয়, মেয়ের গয়না দিতে হয়, না হলে যে সমাজ রক্ষা হয় না।
প্রেমলার তিন ছেলে, দুই মেয়ে। ছেলেরা কেউ সেভাবে লেখাপড়া করেনি। বিভিন্ন কর্মে ঢুকে পড়েছে।
এদিকে বড় মেয়ে এইচএসসি তে পড়ে আরেকজন ক্লাস নাইনে। প্রেমলা জানান, দুইটা মেয়ের বিয়ে দিতে কম করে তিন লাখ, তিন লাখ ছয় লাখ টাকাতো লাগবেই। এই টাকার যোগাড় হলে গ্রামের বাড়ি জামালপুরে ফিরে যাবেন তিনি।
একটা স্বপ্ন খুব যত্নে পুষে রেখেছেন তিনি। কী স্বপ্ন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বড় হইছি ঢাকায়। বিয়েও হইছে ঢাকায়। আমার স্বামী কসমেটিকসের ব্যাবসা করতো। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছিলাম। প্রথমে তিন ছেলে তারপর দুই মেয়ে হয়। সংসারে তখন অভাব। ঠিক করলাম আর সন্তান নেবো না। লাইগেশন করাই। পরে চলে আসি ঢাকা। আমার মা ছিল চুড়িওয়ালা। মায়ের কাছে থাকে ছোটবেলায় ব্যাবসা শিখছিলাম। দুই জনের টাকায় এখন সংসার চলে।’
-আপনি বলছিলেন একটা স্বপ্ন আছে, কী সেটা?
‘আমি আমার ছোট মাইয়াটারে পুলিশের চাকরি করাতে চাই। ওর অনেক সাহস। বড় মাইটা নরম ও পারব না। যদি মাস্টেরি করবার পারে, তাহলে আমি অনেক খুশি হতাম। যে টাকা যৌতুক দেব বলে গুছাইছি দরকার হলে সেই টাকা খরচ করে চাকরি দেব। তারপরে যা হবার হবে। যদি চাকরি নাও দিতি পারি ১৮ বছর বয়স না হলে একটারও বিয়ে দেব না।’
কেন?
‘সংসার অনেক কঠিন মা, সংসার বোঝার জন্যও এতটুকু বয়স দরকার হয়।’
-এখনতো ষোল বছর বয়সেও মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে।
‘যাক, আমি দেব না। আমার মেয়েদের কিসে ভালো হবে, সে আমি জানি।’
প্রেমলা জেনেছে জীবনের কাছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ তাকে যে শিক্ষা দিয়েছে সে জানে জীবনকে মূল্যবান করে তোলার জন্য কীভাবে সরাসরি ভূমিকা রাখা যায়। সে জানে জীবন মানে অনেক কিছু হারানো তবে হেরে যাওয়া নয়।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ডিসেম্বর ২০১৬/স্বরলিপি/শান্ত