সাতসতেরো

ফিরে এসেছে মিঠে তুলসি

বায়েজিদ উল্লাহ : বাংলাদেশে তুলসি গাছ খুবই পরিচিত। এটি মুলত ঔষধি গাছ। শুধু তাই নয়, শোভাবর্ধক গাছ হিসেবেও এর কদর রয়েছে। এ দেশের মানুষ বাড়িতে অনেক যত্ন করে ‍তুলসি গাছ রাখেন।  সর্দি, কাশি ও কৃমি নিরাময়ে তুলসির তুলনা নেই। এটি ফুসফুসের প্রদাহ নাশক এবং শ্বাসতন্ত্রজনিত সমস্যা নিরসনে খুব ভালো সাড়া দেয়। তুলসি পাতা ঝাঁঝালো বিস্বাদযুক্ত। দেশের সর্বত্রই এ গাছ পাওয়া যায়। তুলসি পাতা নিয়মিত সেবনে সুস্থ জীবন লাভ করা যায়। কিন্তু বিস্বাদযুক্ত হওয়ায় এটি খেতে একরকম অনীহা তৈরি হয়। ফলে হাতের নাগালে থাকলেও সহজে কেউ তুলসি খেতে চান না। এমনকি কফ, কাশিতেও এড়িয়ে যান। অথচ ইতালি, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের মানুষ সবসময়ই তাদের খাবারের সাথে তুলসি খায়। অবশ্য সে তুলসি আমাদের দেশী তুলসি না। এটি মিঠে তুলসি (basil)। ইংরেজিতে বলা হয় সুইট বাসিল। এর বৈজ্ঞানিক নাম ওসিমাম বাসিলিকাম (Ocimum basilicum). বাসিল বা তুলসির অনেক প্রজাতি। বাংলাদেশে প্রচলিত চার রকম তুলসির কথা বেশি শোনা যায়। এগুলো হলো- সাদা তুলসি, কৃষ্ণ তুলসি, রাম তুলসি, বাবুই তুলসি। এ ছাড়া আরো প্রজাতির তুলসি আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রজাতির তুলসির দেখা মেলে। স্বাদে, গন্ধে ও পত্রবিন্যাসে প্রত্যেকটিই একে অপরের চেয়ে ভিন্ন। মিঠে তুলসি বা সুইট বাসিলের পাতা দেখতে খানিকটা মিন্ট অর্থাৎ পুদিনা পাতার মতো, তাও আবার পিপার মিন্ট প্রজাতির পুদিনার মতো। ঘ্রাণও প্রচলিত তুলসির চেয়ে বেশ আলাদা, মিষ্টি মিষ্টি। এই পাতা খেতেও বেশ। প্রচলিত তুলসির মত ঝাঁঝালো স্বাদের নয়, মিঠে মিঠে। ইতালিয়ান, থাই ও মিডিল ইস্টার্ন কিছু কুইজিনে সুইট বাসিলের ব্যাপক ব্যবহার আছে। ঔষধি ও পুষ্টিগুণে অন্যান্য তুলসির চেয়ে এটি কম যায় না। তুলসির আছে প্রায় ৫ হাজার বছরের ঐতিহ্য। আর এই সুইট বাসিলের আদি নিবাস ভারতীয় অঞ্চলে। কিন্তু দুঃখজনক যে, এই অঞ্চলেই এটি বিলুপ্তপ্রায়। সঠিকভাবে বংশ বিস্তার ও সংরক্ষণ না হওয়ায় আজ এর এই অবস্থা। অন্য অনেক ঔষধি গাছের মত এই হার্বস অর্থাৎ সুইট বাসিলও মানবস্বাস্থ্যের জন্য আশির্বাদস্বরূপ। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন কে, বিটা কেরোটিন ও আয়রন। এর এন্টি ব্যাকটেরিয়াল, এন্টি ইনফ্ল্যামেটরি, এন্টি অক্সিডেন্ট গুণাগুণ পরিলক্ষিত হয়, যা প্রদাহ কমিয়ে শরীরে বার্ধক্যের ছাপ পড়তে বাধা দেয় এবং রক্তনালীগুলো সতেজ রাখে। এর পাতায় এক ধরণের উদ্বায়ী তেল (এসেনশিয়াল অয়েল) আছে যা এন্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ প্রদর্শন করে এবং অনেক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া জন্মানোয় বাধা সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও সুইট বাসিল রক্ত পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে, রক্ত চলাচল স্বভাবিক রাখায় সহায়ক ভুমিকা পালন করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, প্রদাহ কমায়, কোলেস্টেরল কমায়, রক্তে চিনি (ব্লাড সুগার) নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে ও হৃদপিণ্ড ভালো রাখতে ভূমিকা রাখে। এ ছাড়াও পেটে ব্যথা, জ্বর, বমি বমি ভাব, মাথা ব্যাথা, কাশি ও নানা ধরণের পেটের সমস্যায় ঔষধি হিসেবে ব্যবহার হয়। মিষ্টি ঘ্রাণ ও স্বাদযুক্ত হওয়ায় সুইট বাসিল সেবন খুবই সহজ। পাতা নিয়ে চায়ের সাথে খাওয়া যায়, তরকারি ও সালাদে খাওয়া যায়, বিভিন্ন রান্নায় টপিং হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সর্দি-কাশিতে এর রস যাদুর মতো কাজ করে। থাই, ইতালিয়ান, ভিয়েতনামি রেসিপিগুলোতে সুইট বাসিল বহু ব্যবহৃত একটি উপাদান। এই গাছের যত্নের জন্য কোন বাড়তি সতর্কতার দরকার নেই। প্রচলিত অন্যান্য তুলসির মতো যত্ন নিলেই চলে। রোদ প্রয়োজন। মাটি ভেজা থাকলে পানি দেয়ার প্রয়োজন নেই। নতুন আগা অথবা ডাল কেটে পাতা সংগ্রহ করলে নতুন ডালপালা গজায়, গাছ আরো বেশি ঝোপালো হয়, এর কাণ্ডও শক্তপোক্ত হয়। দেশে কিছু কিছু নার্সারিতে এই গাছ ও এর চারা পাওয়া যায়। বিরল গাছ সংগ্রাহক কয়েকজন বৃক্ষপ্রেমিক এটি সংগ্রহ করেছেন এবং সংরক্ষণ ও বংশবিস্তার করছেন। তাদের মধ্যে অগ্রণী রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকার বাসিন্দা মিসেস উম্মে শাহির বিনতে সাদেক। তিনি কয়েকবছর আগে সিঙ্গাপুর থেকে এই গাছ দেশে এনেছেন এবং এর বংশবিস্তার করে চলেছেন। যাদের কাছে বর্তমানে এই গাছ আছে তাদের বেশিরভাগই এটি সংগ্রহ করেছেন লালমাটিয়ায় এই বৃক্ষপ্রেমীর কাছ থেকে।  লেখক : বৃক্ষপ্রেমী ও উপ সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার, হোমনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কুমিল্লা । রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জানুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ