সাতসতেরো

গোপন বিশ্ববিদ্যালয়

শাহিদুল ইসলাম : শিরোনাম পড়ে হয়তো অনেকেই অবাক হয়েছেন। গোপন বিশ্ববিদ্যালয় আবার কেমন? বিশ্ববিদ্যালয় তো হবে সর্বজনীন, বিশ্বায়নের এক টুকরো উর্বর ভূমি। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে এমনও বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেটির কার্যক্রম চলে লোকচক্ষুর আড়ালে। ‘বাহাই ইন্সিটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন’ এমন একটি গোপন বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এই বিশবিদ্যালয় সম্পর্কে ভালো করে জানতে হলে আগে আপনাকে বাহাইদের সম্পর্কে জানতে হবে। বাহাই ধর্ম বা বাহাই বিশ্বাস হচ্ছে বাহাউল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একেশ্বরবাদী একটি ধর্ম বা বিশ্বাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পারস্যে (বর্তমান ইরান) এই ধর্মের উৎপত্তি। বাহাইরা ঈশ্বরের একত্রিকরণ, ধর্মের একত্রিকরণ আর মানবকুলের একত্রিকরণে বিশ্বাস করে। বাহাই বিশ্বাস অনুসারে, ধর্মীয় ইতিহাস ঈশ্বরের দূতদের ধারাবাহিক আগমনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। তারা প্রত্যেকে নিজ সময়ের মানুষদের সামর্থ্য ও সময় অনুসারে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন আদম (আ.), ইব্রাহিম (আ.), যিশু খ্রিষ্ট, মহামতী গৌতম বুদ্ধ, মহাবতার কৃষ্ণ এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)। এই ধর্মবিশ্বাসে সবশেষে আছেন বাহাউল্লাহ। বাহাউল্লাহ শিক্ষা দেন ঈশ্বর এক, মানবজাতি এক এবং পৃথিবীর সব ধর্ম হচ্ছে এক ঈশ্বরের বিভিন্ন সময়ের প্রকাশ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে বাহাইরা বারবার হয়রানি ও নানাবিধ প্রতিকূলতার শিকার হয়ে আসছে। কারণ মুসলিম ধর্মীয় নেতারা বাহাই ধর্মকে একটি স্বাধীন ধর্ম হিসেবে মানেন না। তারা মনে করেন, এটি ইসলামকে বিকৃত করার একটি অপচেষ্টা। বাহাইদের বিরুদ্ধ সবচেয়ে বড় মাপের হয়রানিগুলো সংগঠিত হয়েছে ধর্মটির উৎসভূমি ইরানে। ইরানে তাদের মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করা হয়। সেখানে তাদের ধর্মীয়, সামজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমন কি শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ইরানে বাহাই ধর্মের অনুসারীরা তাদের নাম পরিচয় গোপন করেই বসবাস করেন। কারণ বাহাইরা হচ্ছে ইরানে ধর্মীয়ভাবে সবচেয়ে সংখ্যালঘু ও নির্যাতিত সম্প্রদায়। বাহাই ধর্মীয় পরিচয়ে কোনো শিক্ষার্থীকে ইরানের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানো হয় না। সামাজিকভাবেও তারা হেনস্থার শিকার হয়। ফলে তাদের শিক্ষালাভ করতে হয় নাম পরিচয় গোপন করে অথবা গোপনভাবে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিরিন এবং মোনা নামের দুজন বাহাই শিক্ষার্থী বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন ইরানে তাদের শিক্ষাজীবনের সংগ্রামী ইতিহাস, তাদের গোপন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের করুণ কাহিনি। আশির দশকে জন্ম নেওয়া শিরিন বলেন, তার পিতা ছোটবেলায় প্রায়ই তাকে তার ( শিরিনের পিতার) শিক্ষাজীবনের করুণ কাহানী শোনাতেন। তিনি (শিরিনের পিতা) বলতেন, শুধু বাহাই হওয়ার কারণে স্কুলে তাকে অনেকবার তার সহপাঠীরা শারিরীক ও মানুষিকভাবে নির্যাতন করেছে। ফলে তিনি শিরিনকে সবসময় স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্তু শিরিন দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। সে গোপনে স্কুল-কলেজের গণ্ডি অতিক্রম করে। তবে আসল বিপত্তিটা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সময়। বাহাই পরিচয়ে একাধিকবার চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পেরে অবশেষে শিরিন সিধান্ত নেয় বাহাই ইন্সিটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন (বিআইএইচই)-এ ভর্তি হওয়ার। তেহরানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ গোপনে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। ১৯৯৪ সালে শিরিন যখন বিআইএইচই-তে ভর্তি হয় তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুটি কোর্সে স্নাতক ডিগ্রি দেওয়া হতো। স্নাতকোত্তর বা পিএইচডি করার কোনো সুযোগ ছিল না। চার বছরের স্নাতক কোর্স শেষ করতে ছয় বা সাত বছর সময় লেগে যেত। সমগ্র তেহরানের বিভিন্ন বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এর ক্লাস রুমগুলো। এভাবে তেহরানের এই গোপন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোই চলছিল শিরিনের দিনগুলো। হঠাৎ একদিন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ রেইড দিলো তাদের গোপন ক্লাসরুমে। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় তার অনেক সহপাঠী ও শিক্ষকদের। ভেঙে যায় শিরিনের স্নাতক হওয়ার স্বপ্ন। তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। তবে শিরিন অন্যদের মতো হেরে যওয়ার পাত্রী নন। ২০০৩ সালে শ্রমিক ভিসা নিয়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। কাজের ফাঁকে ব্রিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে ধর্ম তত্ত্বের ওপর স্নাতক ডিগ্রি সম্পান্ন করেন। এরপর তিনি ২০০৬ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমান। শিরিনের মতো আরেক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হলো মোনা। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে মোনা তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু তার অবস্থাও শিরিনের মতো হয়। বাহাই ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তিনি যদি তার ধর্মের জায়গায় ইসলাম লেখেন তবেই তাকে ভর্তি করানো হবে। এর ফলে মোনাকেও উচ্চশিক্ষার জন্য বেছে নিতে গলো বাহাইদের দ্বারা পরিচালিত গোপন বিশ্ববিদ্যালয়। মোনা তার শিক্ষাজীবনের দূর্বিষহ স্মৃতির কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের ক্লাসরুমগুলো তেহরানের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। মাঝে মধ্যে তাদের সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১২ পর্যন্ত ক্লাস করতে হতো পূর্ব তেহরানে এবং দুপুর ২ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত তাদের ক্লাস করতে হতো পশ্চিম তেহরানে। সবসময় তাদের শিক্ষকরা স্বশরীরে ক্লাসরুমে হাজির থাকতেন না। অধিকাংশ সময় শিক্ষকরা স্কাইপির সাহায্য নিয়ে আমেরিকা কিংবা কানাডায় বসে ক্লাস নিতেন। তার অনেক সহপাঠীদের ইরানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশ-পচিশ ঘণ্টার পথ অতক্রম করে ক্লাসে আসতে হতো। ফলে তাদের দেহে থাকতো ক্লান্তির ছাপ এবং চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা। এভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে তিনি তার স্নাতক শেষ করেন এবং ২০০৯ সালে ভাগ্যের সন্ধানে শিরিনের মতো আমেরিকায় পাড়ি জমান।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৭/শাহিদুল/রাসেল পারভেজ