সাতসতেরো

ইস্ ...

শাহেদ হোসেন : ইস্, কী যে করলাম! এই আক্ষেপ প্রায় প্রতিদিনই কারো না কারো হৃদয় চিড়ে বের হয়। এই বিস্ময়, অবিশ্বাস বা দুঃখসূচক শব্দটি মুখ বলি আর অন্তর বলি, যেখানেই জেগে উঠুক না কেন আগে কিন্তু হ্রস্ব `ই’ এর কাছেই ছুটতে হয়। বাংলা বর্ণমালার তৃতীয় স্বরবর্ণ ‘হ্রস্ব ই’। পূর্ণমাত্রাযুক্ত ছয় স্বরবর্ণের একটি এটি। এর উচ্চারণ স্থান তালু। ব্যঞ্জণবর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে ‘হ্রস্ব ই’ এর আকার ‘ি’ অর্থাৎ হ্রস্ব ই কার হয়। ‘ই’ এর পরিচয় সংক্ষেপে এখানে শেষ হলেও বাংলা বানানে দীর্ঘ ‘ঈ’ এর সঙ্গে এর টানাটানিটা অনেক পুরনো। মুহম্মদ আবদুল হাই বলেছেন, বাংলার মূল স্বরধ্বনির বিচারে দীর্ঘ ‘ঈ’ নেই । ইংরেজিতে `sit' শব্দের হ্রস্ব ‘ই’ এবং ‘seat’ শব্দের দীর্ঘ ‘ঈ’ জাতীয় ধ্বনি বাংলায় নেই। ধ্বনিতাত্ত্বিক দিক থেকে স্বরের দীর্ঘতা ও হ্রস্বতা বাংলা ভাষায় আভিধানিক পর্যায়ে কোনো শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটায় না, যেমন ঘটায় ইংরেজি কিংবা ঊর্দু ভাষাতে। তবে আবেগের তারতম্যের ক্ষেত্রে একই শব্দের স্বরধ্বনি ক্ষেত্রবিশেষে হ্রস্ব ও দীর্ঘভাবে উচ্চারিত হতে পারে, তাতে শব্দের মূল অর্থের কোনো পার্থক্য ঘটে না। বানান বিভ্রান্তির কারণে ১৯৩৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি কিছু তদ্ভব শব্দে হ্রস্ব ই-কার ও কিছু শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার দেওয়ার বিধান দিয়েছিল। হ্রস্ব ই-কার ও দীর্ঘ ই-কার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও বানান সংস্কার কমিটির কর্ণধার সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের অবস্থান ছিল বিপরীতমুখী। একমাত্র সর্বনাম ‘কী’ ছাড়া তদ্ভব বা প্রকৃত বাংলা শব্দে দীর্ঘ ঈ-কার লেখার পক্ষে ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। স্ত্রীলিঙ্গে দীর্ঘ ঈ-কার প্রয়োগেরও বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘হ্রস্ব ই-কে জোর করিয়া দীর্ঘ লিখিতে পার, কিন্তু দীর্ঘত্ব মিলিবে না। যেখানে খাস বাংলা স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ সেখানে হ্রস্ব ইকারের অধিকার, সুতরাং দীর্ঘ ঈ সেখান হইতে ভাসুরের মতো দূরে চলিয়া যাওয়াই কর্তব্য।’(শব্দতত্ত্ব) সময় অনেক গড়িয়েছে। আমাদের বাংলা একাডেমি শুধু সংস্কৃত ছাড়া আর সব শব্দেই ‘ঈ’ ব্যবহারকে বাতিল করে দিয়েছে। এমনকি যে সব সংস্কৃত শব্দের বানানে ঈ বা ই হয় সেখানে শুধু ‘ই’ ব্যবহার করতে বলেছে। বাংলা একাডেমি তাদের প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে বলেছে-

 

১. যেসব তৎসম শব্দে ই বা ঈ উভয় শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল ই এবং তার-কার চিহ্ন ই-কার ব্যবহৃত হবে। যেমন : কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, ধমনি, পঞ্জি, ধূলি, পদবি, ভঙ্গি।

 

২. সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ‘ই’  এবং এর কার চিহ্ন ি  ব্যবহৃত হবে। যেমন- আরবি, আসামি, ইমান, ইরানি ইত্যাদি। স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক শব্দের ক্ষেত্রেও এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। যেমন-নানি, দাদি, বিবি ইত্যাদি।

৩. সর্বনাম, বিশেষণ ও ক্রিয়া-বিশেষণ ও যোজক পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : কী করছ? কী পড়ো? কী খেলে? কী আর বলব? কী জানি? কী যে করি! তোমার কী। এটা কী বই? যেসব প্রশ্নবাচক বাক্যের উত্তর হ্যা বা না হবে, সেইসব বাক্যে ব্যবহৃত ‘কি’ হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লেখা হবে। যেমন : তুমি কি যাবে? সে কি এসেছিল? এবার তত্ত্বকথার ইতি (সমাপ্তি) টেনে শব্দকথায় আসি। আজকাল মা হওয়ার আগ পর্যন্ত স্ত্রীরা স্বামীদের নাম ধরেই ডাকেন । তবে এককালে স্বামী পাশে থাকলে বলতেন ‘আমাদের ‘ইনিতো’ আবার এটা পছন্দ করেন না। সবই যুগের বাতাস। বিদ্যার্থী বলি আর সাধারণ মানুষের কথাই বলি ‘ইঞ্চি’ বলতে সবাই স্কেল বা ফিতার মাপকেই বুঝে থাকেন। তবে পশ্চিমবঙ্গে মাদকসেবীদের কাছে ‘ইনচি’ মানে আফিং আর এই বাংলায় সেই ‘ইঞ্চি’ মানে ফেনসিডিল। তবে পুরান ঢাকায় কিন্তু এখনো ইন্ চি’মারা বলতে খোসামুদি কিংবা অনুরোধ করাকেই বুঝায়। ই-তে চলে আসে ইংরেজদের কথা। ইউরোপীয় এই জাতিটির সংস্পর্শে আমরা ক্ষেপে গেলে অন্যদের ‘ইডিয়ট’ বলাটা ভালোভাবেই শিখেছি। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ইতিউতি (এদিক ওদিক) চাওয়ার অভ্যাস অনেকেরই আছে। অবশ্য দেবরাজ ইন্দ্র নিজেও এ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সেই সুবাদে তিনি গৌতম মুনির স্ত্রী অহল্যার সতীত্বনাশ করেছিলেন্। ভাষার মাস চলছে এখন। ২১ শে ফেব্রুয়ারি অনেকেই শহীদ মিনারে যান 'শ্রদ্ধাঞ্জলি' দিতে। তবে তাদের ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ যখন ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ হয়ে যায় তখন দুঃখই হয়। তাই বিষয়টি নিয়ে আর ‘ইলিশ্ ডিলিশ্’ (আলস্য- বরিশালের আঞ্চলিক শব্দ) না করে আমাদের সবারই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। তথ্যসূত্র :

শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব - মুহম্মদ আবদুল হাই।

ঠাকুরের সহিত বিচার : বাংলা বানানে হ্রস্ব ইকার - সলিমুল্লাহ খান।

বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান - বাংলা একাডেমি।

অপরাধ জগতের ভাষা ও শব্দকোষ - ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক।

প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম : বাংলা একাডেমি।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ