সাতসতেরো

কে যায়, কে যায় ওই উঁকিঝুঁকি চেয়ে?

শাহেদ হোসেন : ‘উঠান ভরা লাউ শসা / ঘরে তার লক্ষ্মীর দশা’। প্রতিবেশী দীর্ঘ ‘ঊ’ এর তুলনায় স্বরবর্ণের পঞ্চম বর্ণ হ্রস্ব-উ এর লক্ষ্মীর দশাই বলতে হয়। কারণ, প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুযায়ী সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে হ্রস্ব-উ এবং এর কার চিহ্ন ‘ ‍ু’ হবে। এমনকি যেসব তৎসম শব্দে উ বা ঊ উভয় শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল উ এবং তার-কার চিহ্ন ‘ ু ’ কার ব্যবহৃত হবে। ‘উ’ হলো একটি পূর্ণমাত্রাযুক্ত স্বরবর্ণ। এটি ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত হয়ে ‘ু ' (হ্রস্ব-ঊকার) চিহ্ন হিসাবে বসে। যেমন : ক্+উ = কু। ‘হ্রস্ব উ’  উচ্চারণের সময় জিহ্বা পশ্চাৎ-তালু বরাবর ওঠে এবং তালু ও জিহ্বার মধ্যবর্তী অঞ্চলের স্থানকে সঙ্কুচিত করে। একইসঙ্গে ঠোঁট গোলাকৃতি ধারণ করে। মুহম্মদ আবদুল হাই বলেছেন, ‘বাংলা বর্ণমালায় আমরা ছেলেবেলা থেকে যে-দীর্ঘ ঈ এবং দীর্ঘ ঊ দেখে এবং শিখে আসছি বাংলার মূল স্বরধ্বনির ব্যবহারিক বিচারে আমাদের সেই দীর্ঘ ঈ এবং দীর্ঘ ঊ নেই।’ চলতি বাংলায় স্বরধ্বনির প্রত্যেকটিই যে মূলধ্বনি তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে কোনো  একটি মূলস্বরধ্বনি উচ্চারণকালে নানাভাবে উচ্চারিত হ’তে পারে। আবেগের প্রাবল্যে কোনো স্থানে অত্যন্ত দীর্ঘ হ’তে পারে। ক্ষেত্রে বিশেষে মাঝামাঝি রকমের দীর্ঘ হ’তে পারে। আবার কোনো ক্ষেত্রে দীর্ঘ কিছু দেখা নাও যেতে পারে। যেমন ‘অপূর্ব’ শব্দের ‘উ’ ধ্বনি। কেউ যদি মুগ্ধ হ’য়ে কোনো দৃশ্যের অপূর্বতার পরিচয় দিতে চায় তা হ’লে খুব টেনে বলে উঠল ‘অপু-র্ ব’। আবার আবেগের তারতম্যে ‘অপূ-র্ ব’ কিংবা ‘অপূর্ব’ শুনতেও পারি।’ বাক্যে সুর সৃষ্টিতেও উ এর ভূমিকা আছে। যেমন-

উঁ-উচ্চ থেকে উন্নীয়মান সুর= প্রশ্নে

উঁ-উচ্চ থেকে অবনীয়মান সুর- ‘তা বটে’ এই অর্থে;

উঁ-নিম্ম থেকে অবনীয়মান ও প্রলম্বিত সুর-‘বেশ, দেখা যাবে’, অথবা-‘বটে, দেখে নেবো’- এই অর্থে

উঁ্ (বা উঁঃ)- আকস্মিক দ্রুত উচ্চারণ-আপত্তি বা বিরক্তি-ব্যঞ্জক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কিন্তু বিয়ে করতে গেলে তিনটি উ-উলু, উদক-স্পর্শিতা, উপবেশন বিধি মেনে চলতেই হয়। আর দাওয়াত খেতে গেলে ‘উপহার’ নিয়ে যাবেন না, তা কি হয়? বিয়ের পরইতো আসে কোলজুড়ে ‘নতুন’ অতিথি। ঈশ্বরচন্দ্র  বিদ্যাসাগর ‘উ’ তে বাঙালি শিশুকে ‘ উট’ চিনিয়েছিলেন। সীতানাথ বসাক অবশ্য মেজাজ সংযতের কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, উ-তে ‘উগ্রভাব’ ভালো নয়। শিশুকালে মন ও মেজাজ সংযত করার শিক্ষাটা ভালোভাবে দেয়া হলে গুরুজন আর গুরুভক্তি দুটোই প্রবল হয়। তবে ডিজিটাল যুগের শিক্ষার কল্যাণে ‘উপমন্যু’ আর ‘উতঙ্কের’ মতো গুরুভক্ত বিদ্যার্থীর দেখা কল্পনাতেও মেলে না। এককালে রকে বসে ‘পিঞ্জরে কেউগা বয়া বাজায় ডগর/উজালা (আলোকিত) কইরা দিলের আন্দা নগর’ গাওয়া ছেলেপুলেরা পাড়ার মুরুব্বিদের দেখলে ঠিকই চুপ হয়ে আরেকদিকে সরে যেত। এখন সেসব আদব-লেহাজ ‘উড়ে’ গেছে। তথ্যসূত্র:

সংক্ষিপ্ত ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ : সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বাঙ্গালা ভাষার অভিধান : শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান : সংকলন ও সম্পাদনা : মোশাররফ হোসেন ভূঞা ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব - মুহম্মদ আবদুল হাই রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ