সাতসতেরো

‘আমার খুব বিপদ, মেয়েটারে বিয়ে দিব’

শাহেদ হোসেন : সাত সকালেই বাসায় মধ্যবয়সী এক নারী হাজির। দরজার বাইরে দাড়িয়ে নরম সুরে আঞ্চলিক ভাষায় সে যা বলছিল, তার মর্মার্থ হচ্ছে, ‘আমার খুব বিপদ। মেয়েটাকে বিয়ে দিতে হবে। একটু আর্থিক সহযোগিতা করুন।’ নগরীটা ইট-পাথরের হলেও রাজধানীবাসীর মনে এখনো যৎকিঞ্চিত দয়া-মায়া আছে। মেয়ের বিয়ের এই মহাবিপদে পাঁচ-দশ টাকা অনেকেই সাহায্য দিয়ে থাকেন। সুর এক, কথা এক। তবে স্থানটি ভিন্ন। মসজিদে মুসল্লিরা নামাজ শেষ করে বের না হতেই মধ্যবয়সী পুরুষের গলা থেকে আওয়াজ ওঠে, ‘আমার খুব বিপদ। মাইয়াডারে বিয়া দিতে হইবো। কিছু দিয়া যান।’ আসলে ভিক্ষার বিষয় নিয়ে কথা বলা নয়, কথা বলা হচ্ছে নারীর প্রতি নিচু দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যায় আচরণের বিষয়ে। আমাদের দেশে বিয়ের সময় প্রচলিত রীতি হচ্ছে, বরপক্ষ কনের বাড়িতে যতো পারে মেহমান নিয়ে যাবে। আচ্ছামতো ভূড়িভোজ করবে। আর ভীরু ভীরু চাহনির মেয়েটিকে নিয়ে আসার সময় নগদ টাকা, ঘর সাজানোর উপকরণ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে আসবে। রীতি শুধু ঐচ্ছিক বিষয়ের মধ্যে থাকলে সমস্যা নেই। কিন্তু যখন এটি বাধ্যবাধ্যকতার পর্যায়ে পড়ে যায়, সমস্যাটা তখনই। বিয়ের সময় বর পক্ষের চাপিয়ে দেওয়া এই রীতির ভারে কনের বাবার কিংবা অভিভাবকের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়। মেয়ের বাবা বিয়ে দিয়ে কিছুটা হয়তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এখানে পুরো না বলে কিছুটা বলছি এ কারণে, বিয়ের পর অন্ততঃ একটি বছর কনের বাপকে আরেকটি ঠ্যালা সামাল দিতে হয়। বরের ঈদের জামা, তার বাবা-মার জামা, ভাই-বোনের জামা, বিভিন্ন পার্বণে বরের পরিবারকে দাওয়াত দিয়ে এনে ভূড়িভোজের ব্যবস্থা করা। এর অন্যথা হলে কনের জীবনটা নরকে পরিণত হয় শ্বশুর বাড়ির লোকদের হাতে। যার একটি মেয়ে রয়েছে, তিনি হয়তো বরের বাড়ির যৌতুকের অত্যাচার থেকে কিছুটা রেহাই পেলেন। কিন্তু যার দুই বা তার চেয়ে বেশি কন্যা রয়েছে তার কথাটা একটু ভাবুন। বেচারার সারাটা জীবন কাটে মেয়েদের কীভাবে বিদায় করবেন সেই দুশ্চিন্তায়। এ কারণেই সমাজে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে ‘মেয়ের বাবারা তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়।’ তাই একবিংশ শতাব্দিতে এসেও এ কারণে কন্যাসন্তান প্রসব করায় স্ত্রীকে হত্যা-নির্যাতন-তালাকের ঘটনা ঘটে। কন্যা সন্তানের প্রতি হয়তো সব বাবার দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বেশ কয়েক বছর আগে এক আত্মীয় গ্রাম থেকে আমার বাসায় এসেছিলেন তার ব্যক্তিগত কাজে। ভদ্রলোক বিকেলে আমাকে নিয়ে বের হলেন মার্কেটে বাচ্চাদের জন্য কিছু কাপড়চোপড় কেনার জন্য। তিন কন্যা আর এক পুত্রের পিতাটিকে দেখলাম উনি যতগুলো জামা কিনলেন সবই ছেলের জন্য। কন্যাদের জন্য কিছুই কিনলেন না। বিষয়টি আমার কাছে যেমন কষ্টের ছিল তেমন ছিল অবাক হওয়ার মতো। তাকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ছেলেটি বড় আদুরে আর আব্দারের। তাই ওকেই বেশি করে দেই। আর মেয়েগুলো? ‘ওদের বেশি কিছু লাগে না, চলে যায় আর কি’। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকই মুসলমান। সেই হিসেবে তাদের অন্তত, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ন্যুনতম জ্ঞানটুকু যদি থাকতো তাহলে নারী সম্পর্কে ধারণাটাই পাল্টে যেত। ইসলাম বরাবরই কন্যা সন্তানের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিয়েছে। যৌতুককে তো স্পষ্ট হারামই ঘোষণা করা হয়েছে শরীয়তে। কন্যা সন্তান সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যার ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহন করল, অতঃপর সে ওই কন্যাকে কষ্ট দেয়নি, তার ওপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে তার ওপর প্রধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারনে আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবশে করাবেন।(মুসনাদে আহমদ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেন, ওই নারী বরকতময়ী ও সৌভাগ্যশালী, যার প্রথম সন্তান মেয়ে হয়। কেননা,(সন্তানদানের নিয়ামত বর্ণনা করার ক্ষেত্রে)আল্লাহতায়ালা মেয়েকে আগে উল্লেখ করে বলেন, তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন।(কানযুল উম্মাহ)। আর বিয়ের নামে আমরা যে অনাচার-অত্যাচার করি সে সম্পর্কেও ইসলাম সুষ্পষ্ট বিধান দিয়ে দিয়েছে। যে বিবাহে খরচ কম হয় সে বিবাহকে বরকতময় বিবাহ আখ্যায়িত করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সর্বাপেক্ষা বরকতময় হলো ওই বিবাহ যা কম খরচে নির্বাহ করা হয়।’(বায়হাকি)। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তো বলেই গেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ প্রতিটি বাবারই ভাবা উচিৎ আমার পুত্র সন্তানকে লালন করতে যেমন অর্থ-শ্রম ব্যয় হয়েছে, তেমনি অন্যের কন্যাটির বেলাতেও এ কথা প্রযোজ্য। বিয়ে মানে বাণিজ্য নয়। বিয়ে মানে নতুন একটি প্রজন্ম সৃষ্টির প্রথম ধাপ। তাই, আসুন যৌতুক কিংবা বিয়ের খরচ যে রুপেই হোক না কেন, কন্যার বাবার টুটি চেপে ধরাটা বন্ধ করি। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৭/শাহেদ/শাহনেওয়াজ