সাতসতেরো

অপারেশন জ্যাকপট এবং একজন নৌ কমান্ডো জিলানী

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে প্রায় সারা বিশ্বেই নাড়া দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অপারেশন। তার নাম ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট নৌ কমান্ডোদের এক রাতের অপারেশন ধ্বংস করে দেওয়া হয় হানাদার বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট। এই জ্যাকপট অভিযানের অন্যতম নায়ক চট্টগ্রামের নৌ কমান্ডো এ এইচ এম জিলানী চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধকালীন তার এই এই দুর্ধর্ষ এবং দুঃসাহসিক অভিযানের স্মৃতিচারণ করেছেন রাইজিংবিডির কাছে। জিলানী চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট। রাতে ছিল তুমুল বৃষ্টি।  বৃষ্টির মধ্যেই আমরা মাইন বুকে বেঁধে কর্ণফুলী নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখনকার সময়ে প্রচণ্ড খরস্রোতা কর্ণফুলী নদীর তীব্র স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করে চট্টগ্রামে অপারেশন জ্যাকপট সফল করেছিলাম। চট্টগ্রাম ছাড়াও একই সঙ্গে ১১টি সেক্টরে নৌ কমান্ডোরা একই সময়ে অপারেশন জ্যাকপট সফল করেন। ধ্বংস করেন শত্রুবাহিনীর ২৬টি জাহাজ। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান থেকে শুরু করে অপারেশন জ্যাকপট পর্যন্ত স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ এইচ এম জিলানী চৌধুরী বলেন, আমি তখন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার নিজামপুর কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। ২৫ মার্চে হানাদার বাহিনীর ক্র্যাকডাউন শুরু হয়ে গেছে। এই সময় আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এপ্রিলে আমরা কয়েকজন ভারতের সীমান্ত পৌঁছে বিএসএফের হাতে আটক হই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে যাওয়ার ইচ্ছের কথা প্রকাশের পর বিএসএফ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের আগরতলায় একটা স্বল্পসময়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠান। কিন্তু আমরা বৃহত্তর প্রশিক্ষণের জন্য খবর নিতে থাকি নানা জায়গায়। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আগরতলা থেকে পশ্চিমবঙ্গের পলাশী প্রান্তরের ভাগিরথীর তীরে আমাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়। সেখানে জানানো হল আমাদেরকে দিয়ে আত্মঘাতী দল তৈরি করা হবে। সেখানে পুরো ভাগিরথী নদী স্বল্পসময়ে সাঁতার কেটে পার হওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশিক্ষণের যোগ্য হিসেবে আমিসহ আরো কয়েকজন উত্তীর্ণ হই। এ এইচ এম জিলানী বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে চলে আমাদের কঠিন অনুশীলন। শরীরের সঙ্গে পাঁচ কেজি ওজনের ইট বেঁধে নদীতে ২০ কিলোমিটার সাঁতার কাটানো হত। এমনও হয়েছে রাত ১২টায় ঘুম থেকে তুলে ভাগিরথীতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের। সাঁতার কেটে আসতে আসতে দেখা গেল ভোর হয়ে গেছে। এভাবে পানির নিচে কমপক্ষে আট থেকে দশ মিনিট থাকার কৌশল আমরা নৌ কমান্ডোরা রপ্ত করে নেই। সাঁতার কেটে আসার পর শুরু হতো আমাদের ডেমোলিশন ও কমব্যাট ট্রেনিং। কিভাবে খালি হাতে শত্রুকে পরাস্ত করতে হয়। কিভাবে ভবন, সেতু, বৈদ্যুতিক স্থাপনা ধ্বংস করতে হয় এ জন্য শেখানো হতো ডেমোলিশন। এভাবে ১৮০ জন নৌ কমান্ডোকে চট্টগ্রাম, মোংলা, নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর নৌ চ্যানেলে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত করা হয়। আমাদের যারা প্রশিক্ষক ছিলেন তারা কখনো ভাবেননি আমরা বেঁচে ফিরতে পারব। যেদিন ক্যাম্প থেকে বিদায় দেওয়া হচ্ছিল সেদিন তারা ভেবেছিলেন এটাই শেষ বিদায়। ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট দেশে ফিরে অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে নৌ কমান্ডো দল। অবশেষে ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ চ্যানেলসহ ১১টি সেক্টরে একই সঙ্গে সফল অভিযানে শত্রুবাহিনীর ২৬টি জাহাজ ও গানবোট ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হন নৌ কমান্ডোরা। চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ চ্যানেলে অপারেশন জ্যাকপট প্রসঙ্গে জিলানী চৌধুরী বলেন, ভারতের আগরতলা থেকে হরিণা হয়ে আমরা ৬০ জনের একটি নৌ কমান্ডো দল সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমরা চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার শাহ আলম মেম্বারের বাড়িতে অবস্থান নেই। পরে সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে কোমরআলী সমিতির হাট এসে পৌঁছাই। সেখানেই অপারেশ জ্যাকপটের জন্য যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করার পরিকল্পনা করি। ১১টি সেক্টরে তিনজন করে কমান্ডোদের ভাগ করে দেন অপারেশনের নেতৃত্বদানকারী এ ডব্লিউ চৌধুরী। তবে পরিকল্পনা ও অস্ত্র মজুদের ক্ষেত্রে হারিছ আহমদ, মঈনউদ্দিন খান বাদলসহ অন্যান্যরা যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্টে আমরা চট্টগ্রামে এসে পৌঁছি। হাজীপাড়া, মৌলভীপাড়া, সিঅ্যান্ডবি কলোনি, আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকার বিভিন্ন জায়গায় আমরা নৌ কমান্ডোরা পৃথকভাবে অবস্থান করি। এরপর ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট রাত। ওই রাতেই শুরু হয় অপারেশন জ্যাকপট। মূলত দুটি গান ছিল অপারেশন জ্যাকপটের নির্দেশনা। প্রথমটি পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ‘আমি তোমায় শুনিয়েছি যত গান’ এবং দ্বিতীয়টি ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুরবাড়ি’। প্রথম গানটি রেডিওতে অপারেশনের ৪৮ ঘণ্টা আগে বাজবে ও দ্বিতীয়টি ২৪ ঘণ্টা আগে বাজবে। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। জিলানী বলেন, এই পরিকল্পনা অনুযায়ী এ ডব্লিউ চৌধুরী নেতৃত্বে ১৫ আগস্ট রাতে আমরা ১১টি স্পটকে টার্গেট করি। এই রাতে ছিল তুমুল বৃষ্টি আর কর্ণফুলী নদীতে ছিল প্রবল স্রোত। এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে গভীর রাতে বুকে মাইন বেঁধে প্রায় ১২ মিনিট সাঁতরে আমরা কর্ণফুলীর এপাড় থেকে ওপাড়ে যাই। চিহ্নিত স্থানে ডুব দিয়ে শত্রুবাহিনীর জাহাজের গায়ের শ্যাওলা সরিয়ে মাইনগুলো লাগাই। এরপর মাইনের পিন খুলে নিয়ে আবার দ্রুত সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছে যাই। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই মাইনগুলো বিস্ফোরিত হলে শত্রুবাহিনীর খাদ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। একই রাতে একই সময়ে নৌ-কমান্ডোরা একযোগে মোংলা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করে হানাদার বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ধ্বংস করে দেন নৌ কমান্ডোরা। রাইজিংবিডি/চট্টগ্রাম/২৪ মার্চ ২০১৭/রেজাউল করিম/রিশিত