সাইফ বরকতুল্লাহ : চৈত্র্যের খাঁ খাঁ গরম। শুক্রবার (৩১ মার্চ ২০১৭) দুপুর দুইটা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আহসানউল্লাহ হলের গেটের কাছে পৌঁছে ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করেই এস এম ফরিদ উদ্দিন এগিয়ে এসে বললেন, চলে আসেন ভেতরে। ভেতরে গিয়ে বসলাম। গায়ে ইউনিফর্ম পড়া। হাতে বই। জিজ্ঞেস করলাম কী বই এটা? বললেন, আমার লেখা বই বর্ণের খেলাঘর। এরপর কিছুটা সময় কথা হয় তার সঙ্গে। এস এম ফরিদ উদ্দিন পেশায় একজন নিরাপত্তা প্রহরী। কাজ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আহসানউল্লাহ ছাত্রাবাসে। ২০১৭ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তার বর্ণের খেলাঘর নামে কবিতার বই বের হয়। এরপর থেকেই পরিচিতি পান তিনি। বিশেষ করে তার কবিতায় ফুটে উঠেছে পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক বর্ণের প্রথম অক্ষর দিয়ে শব্দ তৈরি করে কবিতা লেখা যা বাংলা সাহিত্যে বিরল। যেমন তিনি বর্ণমালায় একুশ কবিতায় লিখেছেন, অসীম আমাদের ইতিহাস, ঈর্ষার উত্থান, ঊঃঋণাত্মক। একুশে ঐখানে ওদের ওঁছা ঐদ্ধত্য।
কণ্ঠভূষা খোকারা গর্জমান ঘূর্ণ্যমান ভঙ্গিমায়,
চক্রান্তকারী ছিল জল্লাদ ঝগড়াটে ঝঞ্ঝাটকারী,
টমিগানে ঠিক, ডাকাত, ঢালধারী ণালিকাস্ত্রে।
তখনই থূর্ত, দীপাগার, ধমনি, ধ্বনি নির্বিচারে।
পেয়েছি ফুলেল বর্ণ, ভাষার মালা,
যখন রক্তে লাল শরণী।
ষড়যন্ত্র সমাপ্ত হলো, বড়ো রূঢ়ি দিয়ে।
আত্মােৎসর্গে বাংলা গীঃহুঁ। বর্ণমালার প্রত্যেক বর্ণের প্রথম অক্ষর দিয়ে পর্যায়ক্রমে শব্দ তৈরি করে ৫২টি শব্দ দিয়ে কবিতাটি লেখা হয়েছে। কিংবা তার অপরিশুদ্ধ ও অপরিহার্য কবিতাটি যদি পড়েন দেখবেন এ কবিতায় প্রথমে পড়লে হবে না-বোধক। আবার প্রত্যেক শব্দ থেকে অ বাদ দিলে হবে হা-বোধক। যেমন-
অন্যায় অবিচার অকর্তব্যের অকাজ।
অসত্য অকথা অনেকের অকল্যাণের। এরকম বিভিন্ন বিষয়ে আরো কয়েকটি কবিতা রয়েছে। ‘বর্ণমালায় একাত্তর’, ‘বর্ণে বর্গে বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘বর্ণমালায় বীরশ্রেষ্ঠ’ কবিতায়ও একই ধরনের ভাষারীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, শব্দসংখ্যা রেখেছেন ঠিক একাত্তরটি। এসব ছাড়াও শুধু ‘আ-কার’, ‘এ-কার’, ‘ই-কার’, ‘উ-কার’ দিয়ে সব শব্দ শুরু হয় এমন কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন বাংলা ভাষায় প্যালিনড্রোম কবিতা (একই লাইনে বাঁ থেকে এবং ডান থেকে পড়লে যার অর্থ একই দাঁড়ায়)। এস এম ফরিদ উদ্দিন বলেন, ২০০৭ সালে বুয়েটে আহসানউল্লাহ হলে গার্ড পদে যোগদান করি। এরপর এই হলের তৎকালীন ছাত্র মেহেদী হাসান ও শুভ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গে প্রায়ই নাটক দেখতে যেতাম। মেহেদী ভাই লেখাপড়ার পাশাপাশি টেলিভিশনে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় তার সঙ্গে নাটক দেখতে গিয়েছি। আমার আগ্রহ দেখে তিনি সাহিত্যচর্চার উৎসাহ দিলেন। এরপর আমি নিয়মিত বাংলা অভিধান ও পত্রিকা পড়তে শুরু করি। এরপর এই হলের প্রভোস্ট (সে সময়) অধ্যাপক খান মাহামদু, ড. ইনামুল হক ও কায়েস চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয়। আর বন্ধু নূরুল ইসলাম রনজু আমাকে কবিতা লেখার পরামর্শ দেন। এরপর শুরু করি ‘মুক্তিযোদ্ধা জঁ ক্যা’ নামের একটি কবিতা দিয়ে। এই কবিতা লিখতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। কবিতাটিতে বাংলা বর্ণমালার ৫০টি বর্ণ মাত্র একবার ব্যবহার করা হয়েছে । এভাবেই শুরু। এস এম ফরিদ উদ্দিন জানান, প্রায় নয় বছর ধরে এই হলে নিরাপত্তারক্ষীর দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে আট বছর ধরে তিনি শুধু রাত্রিকালীন ডিউটি করেছেন। কারণ একটাই, ‘রাতের বেলা পড়াশোনা ও লেখালেখির কাজ অনেক মনোযোগ দিয়ে করা যায়।’ এস এম ফরিদ উদ্দিন জানান, প্রবন্ধ ছাড়া তিনি সব বিষয়ে লিখতে পারেন। তবে চিত্রনাট্য লেখার আগ্রহ আছে তার। গানও লিখেছেন তিনি। এস এম ফরিদ উদ্দিনের জন্ম কিশোরগঞ্জের পাঁচধা গ্রামে ১৯৮১ সালের ৪ মার্চ । এএসসি পাস করার পরে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজে। অভাব-অনটনের কারণে এইচএসসি আর পাস করা হয়নি। তবে কবিতার প্রচলিত ব্যাকরণে তিনি বেখেয়াল। শব্দ ও বর্ণ খেলে তিনি স্বপ্ন দেখেন কবিতার নতুন এক ভূবন নির্মাণের। বাংলা বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষর দিয়ে নতুন নতুন শব্দ বানিয়ে অর্থময়তার দার্শনিক উপকূলে উপনীত হওয়ার চেষ্টা তার নিরন্তর। ফরিদ উদ্দিনের কবিতাগুলো কবিতার কোনো ছাঁচে পড়ে কি না , তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এই কবির প্রাণ-প্রয়াস পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে এটা নির্দিধায় বলা যায়। লেখালেখি নিয়ে তার স্বপ্ন অনেক। সামনে আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে চান তিনি। হতে চান একজন কালজয়ী লেখক। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ এপ্রিল ২০১৭/সাইফ