সাতসতেরো

হাওরজীবী ও হাওরের কথন

ইমতিআজ শিপন : বাংলাদেশে যে কয়েকটি হাওর অঞ্চল রয়েছে তার মধ্যে সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চল অন্যতম প্রধান। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চলে ২৯ মার্চ সৃষ্ট হওয়া অকাল বন্যায় বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলসমূহ থেকে বোরো ধান উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ শতাংশ তলিয়ে গেছে। রাসায়নিক বিষক্রিয়ার ফলে এ বছরের মৎস্য সম্পদ উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৩৯ লাখ মেট্রিকটনের মধ্যে ১ হাজার ২০০ মেট্রিকটন মৎস্য সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সরজমিনে দেখার জন্য সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চলে গিয়ে কথা বলা হয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগী হাওরজীবীদের সঙ্গে। এবারের অকাল বন্যায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শোকে শোচনীয় হাওরজীবীদের সঙ্গে তাদের দঃখ-দুর্দশা নিয়ে কথা বলার সময় নলুয়া হাওর পাড়ের প্রান্তিক কৃষক ষাটোর্ধ হাসেম আলী বলেন, ‘হাওরই মা-বাপ, হাওরই যম’। হাওরের যম রূপ ও লক্ষ্মী রূপ দেখতে দেখতে তার বয়স হয়েছে ষাটের ওপর। যিনি মনে করেন, এবারের অকাল বন্যায় হাওরের ক্ষয়ক্ষতি অভূতপূর্ব। সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চলে, জৈষ্ঠ্য থেকে কার্তিক, এই ছয় মাস জলে পরিপূর্ণ থাকে। হাওরের জমিন এক ফসলি জমিন; বছরে একবারই ফসল ফলে; বোরো ধান। এই বোরো ধান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই বছরের অধিকাংশ সময় সংসার-যাত্রা নির্বাহ করে থাকেন সুনামগঞ্জের হাওরজীবীরা। এবং বছরের অবশিষ্ট সময়ে জীবিকা নির্বাহ করেন হাওর থেকে মৎস্য আহরণ করে। সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের কাছে 'বন্যা এবং অকাল-বন্যা' সুপরিচিত। অন্যান্য বার অকাল-বন্যা হলেও তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিলো যৎসামান্য। যার জন্য তাদের কখনো মাথায় হাত রেখে আহাজারি করতে হয়নি। অতীতের অকাল-বন্যা এসেছে বৈশাখের শেষের দিকে ধান কাটার উপযোগী হওয়ার এবং অধিকাংশ পাকা ধান ঘরে তোলার পরে- ফলে বন্যা এলেও ক্ষতি হয়েছে অল্প। এবারের অকাল-বন্যা এসেছে চৈত্রের মাঝামাঝিতে। যৎকিঞ্চিত পরিমাণ ধান ঘরে তোলার উপযোগী হলেও, ঘরে আনা যায়নি, কাঁচা ধানের পরিমাণ শতাংশে ৯৯.- এর উপরে। এবারের অকাল-বন্যায় সৃষ্ট বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাওরজীবীরা হিসাব করছেন শতকরায়- এক শ-তে এক শ ভাগ। এবারের বন্যায় বিপুল শস্য ক্ষতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মৎস্যে মহামারি। মহামারিতে মরে উজাড় হয়েছে জলজপ্রাণী। ফলে, শস্য ক্ষতিতে বিপর্যস্ত হাওরজীবীদের জীবন ধারণের জন্য শেষ সম্বল হিসেবে যে মৎস্য সম্পদ ছিলো সেটিও থাকছে না, যা সম্বলহীন হাওরজীবীদের দাঁড় করিয়েছে অস্তিত্ব রক্ষার কঠিন প্রশ্নের সামনে। নলুয়ার হাওর, মইনা হাওর এবং পিঙ্গলার হাওরজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই হাওর অঞ্চলে অকাল-বন্যায় ধানের ক্ষয়ক্ষতি হলেও ইতিপূর্বে কখনো এবারের মতো মৎস্য সম্পদ উজাড়ের ঘটনা কখনই ঘটেনি। এই হাওর অঞ্চলের প্রবীণদের ভাষ্যমতে, মৎস্য সম্পদ নষ্টের ঘটনা তারা এবারই প্রথম প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তারা তাদের প্রজ্ঞাবান পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেও কখনো শোনেননি। মাছের মড়কের বিষয়টিকে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রারম্ভিক দৃশ্যমান কারণ বলে বিবেচনা করে থাকেন। জলজ প্রাণে মহামারির কারণ হিসেবে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তার কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তায় জলজপ্রাণীর মৃত্যুর খবরের গ্রহণযোগ্য কোনো উৎস্যের সন্ধান না পাওয়ায় প্রকৃত কারণ জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হয় সংশ্লিষ্ট মৎস্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে। সুনামগঞ্জের জগন্নাপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়াহিদুল আবরার জানান, মাছ মরে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে তারা হাওরের পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখেন। তারা হাওরের ইকোসিস্টেমকে চারটি প্যারামিটারে পরীক্ষা করেন। যে চারটি প্যারামিটারের ফলাফল নির্দেশ করে জলজ-ইকোসিস্টেমে ভারসাম্যতা বিরাজ করছে না। চারটি প্যারামিটারের একটি হচ্ছে জলের পিএইচ এর মান। পিএইচ এর মান নির্দেশ করে পানি অম্লীয় না ক্ষারীয়। পিএইচ স্কেলে মান শূন্য থেকে চৌদ্দ পর্যন্ত থাকে। মিঠাপানির আদর্শ পিএইচ এর মান ধরা হয় ৬.৫-৭.৫। পিএইচ এর মান ছয় দশমিক পাঁচ এর নিচে নেমে যাওয়া মানে বোঝায়, পানি অম্লীয়। এবং পিএইচ এর মান ৭.৫ এর উপরে উঠা মানে বোঝায় পানি ক্ষারীয়। পানিতে পিএইচ এর মান আদর্শ অবস্থা থেকে সরে যাওয়া মানেই প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক। আদর্শ মান থেকে পিএইচ এর মানের বেশি তারতম্য জলজ প্রাণী (একুয়াটি এনিমাল) এর মৃত্যু ঘটাতে পারে। সুনামগঞ্জ হাওরের মৎস্য ও মৎস জাতীয় প্রাণীর অকাল-মৃত্যু শুরু হয় ১৬ এপ্রিল। এ দিন হাওরের জলে পিএইচ এর মান ছিল ৪. এর কাছাকাছি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জলজ প্রাণীর মড়কের কারণ হিসেবে পিএইচ এর মানকে গণ্য করছেন। চারটি প্যারামিটারের দ্বিতীয় প্যারামিটারটি হচ্ছে, টিডিএস (টোটাল ডিজলভড সলিড) বা মোট দ্রবীভূত কঠিন বস্তুর পরিমাণ। সাধারণত টিডিএসকে প্রধান দূষক হিসেবে ধরা হয় না, এটিকে স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেও মনে করা হয় না। টিডিএসকে মূলত খাবার পানির বিশুদ্ধতার একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং পানিতে রাসায়নিক দূষক দ্রব্যের সামগ্রিক উপস্থিতির নির্দেশক হিসেবে ধরা হয়। মিঠাপানির প্রাণীর ক্ষেত্রে টিডিএস এর আদর্শ মান ধরা হয় ৮০ থেকে ২০০। পানিতে টিডিএস এর আদর্শ মানের তারতম্য ঘটলে পানি ঘোলা হয়, যা জলজ প্রাণীর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসে বিঘ্ন ঘটায়। মহামারি শুরুর সময়ে হাওর জলে টিডিএস এর মান ছিল ৫০-৬০। জলজ ইকো সিস্টেমকে ডিও(ডিজলভড অক্সিজেন) বা দ্রবীভূত অক্সিজেন পরীক্ষার মাধ্যমেও পরীক্ষা করা হয়। ডিও টেস্ট নির্দেশ করে পানিতে কী পরিমাণ অক্সিজেন দ্রবীভূত আছে। মিঠাপানির প্রাণীর ক্ষেত্রে ডিও এর আদর্শমান ধরা হয় ৫.০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিওন)। আদর্শমান থেকে সরে আসা মানে পানিতে অক্সিজেনের পরিমান কমে যাওয়া। ১৬ এপ্রিল হাওর জলে ডিও রেকর্ড করা ২.০ পিপিএম। ১৭ তারিখে ০.১২-১.০ পিপিএম, ১৮ তারিখে ০.১৫-০.৫ পিপিএম, ১৯ তারিখে ০.৫ পিপিএম, ২২ তারিখে ২.০ পিপিএম। যা স্পষ্টতই পানিতে অক্সিজেনের মারাত্মক অভাবকে নির্দেশ করে। চার নম্বর প্যারামিটারটি পানিতে অ্যামোনিয়া পরিমাপের পরীক্ষা। জমিতে ধান চাষের জন্য কৃষকেরা ইউরিয়া সার ব্যবহার করে থাকেন। ইউরিয়া পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন করে এবং পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমায়। মিঠাপানির প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অ্যামোনিয়ার আদর্শমান ধরা হয় ১.০পিপিএম। ১৬ এপ্রিলে হাওর জলে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ছিল .০.৫পিপিএম। এই চারটি প্যারামিটারে ফল বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মাছের মহামারির কারণ হিসেবে হাওরের পানিতে অক্সিজেনের অভাবকেই প্রধান কারণ বলে মনে করছেন। ২০১১ সালে ফিলিপাইনে পানিতে অক্সিজেনের অভাবে ৫০০ মেট্রিকটন মাছ মারা যায় এবং একই বছর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় লাখ লাখ মাছ মারা যায়। পরিস্থিতি সামলাতে মৎস্য অধিদপ্তর, হাওরের জলে জিওলাইট ও চুন ব্যবহার করে জলজ ইকো সিস্টেমে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছেন বলে জানান। এই বিস্তীর্ণ দূষিত হাওর জলরাশির অনুপাতে ব্যবহৃত জিওলাইট ও চুনের পরিমাণ পর্যাপ্ত কি না সেটি হিসেব করে বের করতে হবে। একদিকে হাওরে ধান পচে যাচ্ছে, অন্য দিকে মাছ। ধান পঁচার কারণে হাওরের পানি অনেক আগেই হয়ে পড়েছে ব্যবহার অনুপযোগী। মৎস্য ও মৎস্য জাতীয় প্রাণীর পচনের ফলে তৈরি হয়েছে বসবাস অনুপোযোগী পরিবেশ। স্থানীয় প্রশাসন মাছ না খাওয়ার নির্দেশ দিলে হাওর অঞ্চলের লোকজন মাছ খাওয়া বন্ধ করে দেন। ফলে জেলে সম্প্রদায় পড়েছে বিপাকে। মৃত মাছের সৎকারের আশু কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে হাওর অঞ্চলের বাতাস হয়ে পড়েছে দুর্গন্ধময়, যেখানে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। দেখা দিচ্ছে ডাইরিয়ার মতো পানিবাহিত রোগ। ফলে শস্য ও মস্য ক্ষতির সঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের সম্ভাবনার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন এনজিওর তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া একান্তই প্রয়োজন। সুনামগঞ্জে রেমিটেন্সের উল্লেখযোগ্য প্রবাহ থাকায় এই অকাল বন্যার ফলে অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড়িয়েছেন মূলত দুই শ্রেণীর মানুষ- প্রান্তিক কৃষক এবং নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক। বিপদগ্রস্ত সকলের পাশে দাঁড়ানোই পুণ্যের কাজ। যেসব পরিবারে রেমিটেন্সের প্রবাহ আছে সেসব পরিবার এই দুর্যোগ মোকাবেলার শক্তি সঞ্চয় হয়তো এর মধ্যেই করেছেন। কিন্তু, যাদের পরিবারে রেমিটেন্সের কোনো প্রবাহ নেই, তাদের আগে সাহায্য ও সাহস দেওয়া প্রয়োজন। ঋণ নিয়ে তারা যে হাওরে খাটিয়েছেন, সে হাওর জলের নিচে। ঋণের বোঝা ঘাড় থেকে যায়নি। সরকার তাদের ঘাড় থেকে ঋণের সুদের বোঝা নামিয়ে দিয়ে এবং পরবর্তীতে সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে মাথা তুলে দাড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এবং প্রেরিত ত্রাণের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণ ও মজুতদারদের কবল থেকে হাওরজীবীদের রক্ষা করেই এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে হবে। আমাদের দৃষ্টি যেনো বন্যার্ত হাওরজীবীদের উপর থেকে না সরে, সে জন্য তাদের নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে যাওয়া নৈতিক দায়িত্ব। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ এপ্রিল ২০১৭/ইমতিআজ/রাসেল পারভেজ