সাতসতেরো

এসো নীপবনে, আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ

শাহ মতিন টিপু : এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে...।  আজ পয়লা আষাঢ়। রূপময় ঋতু বর্ষার প্রথম দিন।  বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বর্ষা ঋতুর শুরুটা হবে আজ। আনুষ্ঠানিক ঋতু বর্ষার শুরু । বাংলায় আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষা ঋতু। বর্ষাকাল চলবে শ্রাবণের শেষ দিনটি পর্যন্ত। এবার বর্ষা  আমাদের দ্বারে এসেছে যেন একটু বেশি বেদনার ডালি নিয়েই। আমাদের চট্টগ্রামের পাহাড়ে পাহাড়ে এখন লাশের সারি। শোকাতুর পরিবেশ সেখানে। এই শোকে আচ্ছন্ন হয়েছে গোটা দেশ। এবার বর্ষা  যেন নিজেকে জানান দিয়েই এল । স্বরূপেই আবির্ভূত হলো গরমের দাপটকে দমাতে । বৃষ্টি হচ্ছে ক’দিন ধরেই। নদীতে পানি উপচেপড়া। কোথাও বিপৎসীমা ছাড়িয়ে। আকাশেও মেঘের ঘনঘটা। নিম্নচাপ, ঝিরঝির বৃষ্টি জানিয়েই দিল সময়টা এখন তার। সময় এখন বর্ষার । চিরকালই আষাঢ় সাজে নানা রূপে। বৃষ্টিরধারায় নবতর জীবন আসে পুষ্প-বৃক্ষে, পত্রপল্লবে, নতুন প্রাণের সঞ্চার করে প্রকৃতির অবয়বে। নতুন সুরের বার্তা নিয়ে সবুজের সমারোহে আগমন বর্ষার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশও ছেয়ে... আসে বৃষ্টিরও সুবাস ও বাতাসও বেয়ে...’ কিংবা ‘ঐ আসে ঐ ঘন গৌরবে নবযৌবন বরষা, শ্যাম গম্ভীর সরসা...’ কিংবা ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়, এমনও ঘনঘোর বরষায়...’। বর্ষা বাঙালী জীবনে চিরকালই কামনার। আজও ফুরায়নি সে আবেদন। কারণ, বর্ষা মানেই সতেজ বাতাসে জুঁই, কামিনি, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা আরো কত ফুলের সুবাস। লেবু পাতার বনেও যেন অন্য আয়োজন। উপচেপড়া পুকুরে রঙিন হয়ে ফোঁটে পদ্ম, সে কেবলই বর্ষাকে পাওয়ার জন্য। কেয়ার বনেও কেতকীর মাতামাতি। আহা কত না মধুর এই বরষা। যদিও সে বর্ষা এখন কল্পনাতেই বেশি খুঁজে নিতে হয়। ইতিহাস বলে এ সময় জলীয় বাষ্পবাহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয় বর্ষায়। তাই চারপাশের পরিবেশ বদলে যায়। আসুন আমরা আজ মনটাকে ধুয়ে ফেলি প্রতিকী বর্ষার জলে। ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল’-এর ভুবনভুলানো হাসি মনে ধারণ করি । কী গ্রাম, কী নগর সর্বত্রই বর্ষার আগমনী বার্তা দেয় কদম। যেন একই কথার জানান দিতে পেখম মেলে ময়ূর। বৃষ্টির জল গায়ে নিয়ে নৃত্য করে। বর্ষায় প্রকৃতির এমন পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে নজরুল লিখেছেন- রিমঝিম রিমঝিম ঘন দেয়া বরষে

কাজরি নাচিয়া চল, পুর-নারী হরষে

কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে

কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে,

মনের বনের মুকুল খোলে

নট-শ্যাম সুন্দর মেঘ পরশে...। বর্ষায় নিজের চিত্তচাঞ্চল্যের কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-

মন মোর মেঘের সঙ্গী,

উড়ে চলে দিগ্ দিগন্তের পানে

নিঃসীম শূন্যে শ্রাবণবর্ষণ সঙ্গীতে

রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম...। রিমঝিম এ বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দে কাটে বাঙালীর শৈশব। স্কুলে যেতে যেতে কিংবা ফেরার পথে দুরন্ত কিশোরী আনন্দে গায়ে মাখে বৃষ্টির ফোঁটা।  তুমুল বৃষ্টিতে গাঁয়ের ছেলেরা নেমে পড়ে ফুটবল নিয়ে। বর্ষার এই রূপ কখনো কি ভোলা যায়? বর্ষার সবই উপভোগ্য। আবার ভারি বর্ষণে, পাহাড়ী ঢলে গ্রামের পর গ্রাম যে ভাসিয়ে নেয় সেও বর্ষা! বন্যাকবলিত নিচু এলাকার মানুষ তাই আতঙ্কে পার করে বর্ষা। একই কারণে সারা বছরের অর্জন ফসল তলিয়ে যায়। শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। সুখ স্মৃতিগুলো মনে রেখেই প্রতিবছর বর্ষাকে বরণ করে নেয় বাঙালী। বিশেষ করে শহরে নগরে হরেক আয়োজনে চলে বর্ষা বন্দনা। প্রতিবারের মতো এবারও রাজধানীতে আজ বর্ষাবরণে নানা আয়োজন রয়েছে। বর্ষার রাগিনীতে বর্ষাকে বরণ করে নেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, আজ অনেকেই মেতে উঠবেন বর্ষাবরণ উৎসবে। দেশের নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে বর্ষাকে নিয়ে নানা মিথ। আগেই বলেছি হঠাৎ বর্ষা যেমন আনন্দের, তেমনি হঠাৎ বিষাদে ভরিয়ে তোলারও। বন্যা তার ভয়ংকর রূপটির নাম। তবুও বর্ষা বাঙালী জীবনে নতুনের আবাহন। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাঙলা মায়ের নবজন্ম এই বর্ষাতেই। বর্ষার ফেলে যাওয়া অফুরন্ত সম্ভাবনার পলিমাটি থেকেই উন্মেষ ঘটে সারা বছরের খাদ্য-শস্য-বীজের।

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুন ২০১৭/টিপু