সাতসতেরো

শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি

রুহুল আমিন : আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।

নষ্টদের দানব মুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক

সব সংঘ পরিষদ;-চ’লে যাবে অত্যন্ত উল্লাসে

চ’লে যাবে এই সমাজ সভ্যতা-সমস্ত দলিল-

নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র

আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চ’লে গেছে নষ্টদের

অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর গ্রাম ধানখেত

কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক

মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ নির্জন প্যাগোডা।

অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;

চাষার সমস্ত স্বপ্ন আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন

সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে। (সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে) আসলেই সব কিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে। এখন বিশুদ্ধতার ছড়াছড়ি নেই কোথাও। কোথাও কোনো শান্তির সু-বাতাস নেই। শুভ বোধ যেন স্বপ্নের মতো কোনো ব্যাপার। এমনটা তো হওয়ারই কথা। এই কথা আরো অনেক আগেই বলে গিয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। আজ তার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি তাকে। ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট রাতে জার্মানিতে একটি পার্টি থেকে ফেরার পর আবাসস্থলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট ফ্ল্যাটে নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃত্যুর পর তার মরদেহ জার্মানি থেকে ঢাকায় আনা হয়। পরে তাকে তার জন্মস্থান রাড়িখালে সমাহিত করা হয়। তার শৈশব কাটে বিক্রমপুরের রাড়িখালে । ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত রাড়িখালের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠেন তিনি। জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে নানাবাড়ি কামারগাঁওয়ে।তখন তার নাম রাখা হয়  হুমায়ুন কবীর । পরে ১৯৮৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর নাম পরিবর্তনের মাধ্যম তিনি হুমায়ুন আজাদ নাম ধারণ করেন। বাবা আবদুর রাশেদ প্রথম জীবনে বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, পরে পোস্টমাস্টার ছিলেন। আরও পরে ব্যবসায়ী হন। মা জোবেদা খাতুন একজন গৃহিণী ছিলেন। হুমায়ুন আজাদ ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য স্নাতক ডিগ্রি ও ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি একজন আদর্শবান  শিক্ষক। ১৯৬৯ সালে তার কর্মজীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক হিসেবে। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পান। ১৯৭২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। হুমায়ুন আজাদকে বলা হয় প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক মননশীল লেখক। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০এর বেশি। কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০, উপন্যাস ১৩টি, সমালোচনা গ্রন্থ ২২টি, কিশোরসাহিত্য ৮টি, ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ সংখ্যা ৭টি। মূলত তিনি প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থের জন্যই বেশি আলোচিত। ১৯৯২ সালে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘নারী’ প্রকাশ করে গোটা দেশে আলোড়ন তুলে ফেলেন। ভাষাবিজ্ঞান গবেষণায় তার রয়েছে বিশেষ অবদান। পিএইচডি ডিগ্রির জন্য হুমায়ুন আজাদ বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলার ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা ভাষার বাক্যতত্ত্বের ওপর ‘বাক্যতত্ত্ব’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। একই বছরে তিনি ‘বাঙলা ভাষা’ শিরোনামে দুই খণ্ডের একটি দালিলিক সঙ্কলন প্রকাশ করেন। এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা ভাষাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি পরবর্তী কালে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান ও অর্থবিজ্ঞানের উপর দুটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক লেখেন। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলা ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ুন আজাদ বিয়ে করেন ১৯৭৫ সালে। স্ত্রী লতিফা কোহিনুর । তার দুই কন্যা মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং এক পুত্র অনন্য আজাদ। ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। তার রচিত কিশোরসাহিত্য ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ জাপানি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ২০০৪ সালে তার ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে দেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন।  ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের হামলার শিকার হন তিনি। বিদেশে নিবিড় চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হন। ১১ আগস্ট রাতে জার্মানিতে ফ্ল্যাটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন । হুমায়ুন আজাদ নেই কিন্তু তার আদর্শ এখনো আলোর পথ দেখায় অন্ধকার থেকে আলোয় আসাতে আগ্রহী মানুষকে। তিনি প্রথা ভেঙে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। তিনি অনেক কঠিন কথা সহজে কবিতায় বলে গেছেন। মৃত্যুকে তিনি খুব বড় করে দেখতেন না। তাই তিনি বলতে পেরেছেন-

আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্যে মারা যাবো

ছোট্ট ঘাসফুলের জন্যে

একটি টলোমলো শিশিরবিন্দুর জন্যে

আমি হয়তো মারা যাব চৈত্রের বাতাসে

উড়ে যাওয়া একটি পাপড়ির জন্যে

একফোঁটা বৃষ্টির জন্যে (আমি সম্ভবত খুব ছোট্ট কিছুর জন্য মারা যাবো) হুমায়ুন আজাদই সাহস করে বলেছিলেন, ‘একজন রাজাকার চিরদিন রাজাকার, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা চিরদিন মুক্তিযোদ্ধা না’। হুমায়ুন আজাদ বুঝেছিলেন, আমরা এখনো বুঝিনি। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ আগস্ট ২০১৭/রুহুল/শাহনেওয়াজ