সাতসতেরো

গানের অতুলপ্রসাদ

শাহ মতিন টিপু : অতুলপ্রসাদের গান আজও মুগ্ধ করে আমাদের। মুগ্ধ করার মতোই গানের কথা তার। যা মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছে যুগের পর যুগ। যেমন-‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!/ তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!/ কি যাদু বাংলা গানে!- গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,/ এমন কোথা আর আছে গো!/ গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।’ এমন গানের কথা কার না হৃদয় ছুঁয়ে যায়।বাংলাদেশের  ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিদের মধ্যে অফুরন্ত প্রেরণা জুগিয়েছে এ গান । অতুলপ্রসাদের ৮৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট তিনি প্রয়াত হন। বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্রময় জীবনের অতুল প্রসাদের জন্ম ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকায় তার-ই মাতুলালয়ে। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল দক্ষিণ বিক্রমপুরে।  তার পিতার নাম রামপ্রসাদ সেন এবং মায়ের নাম হেমন্তশশী। অতি অল্পবয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদ। এরপর মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের কাছে প্রতিপালিত হন। পিতাকে হারানোর পর তার বিধবা মা হেমন্তশশী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর জ্যাঠামশাই দুর্গামোহন দাশকে বিবাহ করেন। এতে তিনি মানসিকভাবে অত্যন্ত আঘাত পান। তখন তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরপর মামাদের অনুরোধে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৮৯০ সালে বিলেত যান ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য, তার মামারা তাকে বিলেত যাবার ব্যবস্থা করেন। এই যাত্রার পিছনে অলক্ষ্যে সহযোগিতা করেন তার সৎপিতা দুর্গামোহন দাশ। জানতে পেরে তিনি দুর্গামোহন দাশের সাথে দেখা করেন এবং এর ভিতর দিয়ে তার মা এবং সৎপিতার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। ইংল্যান্ডে যেতে জাহাজে বসে তিনি রচনা করেছিলেন ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’ গানটি। লন্ডনে গিয়ে তিনি আইন শিক্ষা করেন এবং আইন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। এই সময় তার বড় মামা কৃষ্ণগোবিন্দ সপরিবারে লন্ডনে যান। অতুলপ্রসাদ নিয়মিতভাবে লন্ডনের মামাবাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করেন। এই সূত্রে তার মামাতো বোন হেমকুসুমের সাথে ঘনিষ্ঠতা জন্মে। ১৮৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এক্ষেত্রে তাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন দুর্গামোহন দাশ। ১৮৯৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবে 'খামখেয়ালী সভা' প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সভায় যাওয়া-আসা ছিল অতুল প্রসাদের। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এই আসরে উপস্থিত থাকতেন বাংলা সঙ্গীতের অপর কৃতি পুরুষ ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। এই আসর হাস্যরসাত্মক গান ছাড়াও রাগসঙ্গীতের মতো উচ্চাঙ্গের গান হতো। আইন ব্যবসায় কলকাতায় ততটা পসার জমাতে পারলেন না। ১৮৯৭ সালে দুর্গামোহন দাশ পরলোকগমন করেন। ফলে অতুলপ্রসাদকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়। আর্থিক সুবিধা লাভের আশায় তিনি রংপুরে চলে যান।এই সময় তার সাথে হেমকুসুমের সম্পর্কের কথা জানাজানি হয় । হিন্দু রীতিতে এই বিবাহ অসিদ্ধ তাই পারিবারিক চাপের মুখে পড়েন। এ কারণে পুনরায় বিলাত যান এবং স্কটল্যান্ডের রীতি অনুসারে বিয়ে করেন। বিলেতেই আইন ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু এখানেও কোনো সুবিধা করতে পারলেন না। ১৯০১ সালে তাদের যমজ পুত্র সন্তান জন্ম হয়। এই সময় তিনি প্রচন্ড আর্থিক কষ্টের ভিতর পড়েন। সংসারের খরচ মেটাতে এক সময় হেমকুসুম গহনা বিক্রয় শুরু করেন। এর ভিতর এক সন্তান সাত মাস বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এই চরম হতাশা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে এক বন্ধু তাকে উত্তরপ্রদেশের লখনৌতে আইন ব্যবসার পরামর্শ দেন। ১৯০২ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় আত্মীয়-স্বজনেরা তাকে বর্জন করলে লখনৌতে চলে যান। এখানে নিজেকে প্রথম শ্রেণির আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ক্রমে ক্রমে লখনৌ শহরের বিশিষ্ট জনে পরিনত হন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এই দিনে রবীন্দ্রনাথের আহবানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধনের প্রতীক হিসাবে ‘রাখিবন্ধন’ -এর ব্যবস্থা করা হয়। অতুলপ্রসাদ এই অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতায় আসেন এবং ‘রাখিবন্ধন’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। লখনৌতে ফিরে স্বদেশি চেতনায় ভারতীয় যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে 'মুষ্ঠিভিক্ষা সংগ্রহ'-এর সূচনা করেন। পরে এই সূত্রে প্রতিষ্ঠিত হয় 'আউধ সেবাসমিতি'। এই সময় অতুলপ্রসাদের আত্মীয়স্বজনেরা, বিশেষ করে তার মা সব ভুলে গিয়ে সম্পর্ককে উন্নত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই কারণে তার মা লখনৌতে আসেন। অতুলপ্রসাদও সব ভুলে গিয়ে সম্পর্ক দৃঢ় করায় আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু তার স্ত্রী হেমকুসুম অতীতকে ভুলতে পারেননি। তাই তিনি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেননি। ফলে শুরু হয় পারিবারিক সংঘাত । পরম অশান্তি নিয়ে অতুলপ্রসাদ ১৯১১ সালে তৃতীয় বার ইংল্যান্ডে যান। ১৯১৪ সালে রবীন্দ্রনাথ হিমালয় ভ্রমণের পর রামগড় এলে তিনি অতুলপ্রসাদকে আমন্ত্রণ জানান। অতুলপ্রসাদ রামগড়ে গিয়ে কিছুদিন কাটান। পারবারিক সংঘাতের কারণে স্ত্রী হেমকুসুমের সাথে তার সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে। এর কিছুদিন পর তিনি লখনৌ ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে যোগদান করেন এবং কলকাতার একটি ফ্লাট বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন শুরু করেন। ১৯২৩ সালে লখনৌতে রবীন্দ্রনাথ এলে স্ত্রী হেমকুসুম পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে অতুলপ্রসাদের কাছে আসেন এবং একসঙ্গে কবিকে সম্বর্ধনা দেন। সম্বর্ধনা শেষে রবীন্দ্রনাথ বোম্বে চলে যান। এরপরই হেমকুসুম পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে অন্যত্র চলে যান। ১৯২৫ সালে লখনৌতে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনে তিনি সভাপতি হন। এই অধিবেশনে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতুলপ্রসাদ এর নামকরণ করেন 'উত্তরা'। এই সময় হেমকুসুম দেরাদুনে যান। সেখানে টাঙ্গা থেকে পড়ে গিয়ে তার ‘পেলভিস্ বোন’ ভেঙ্গে যায়। অতুলপ্রসাদ দেরাদুনে গিয়ে তার চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা করে লখনৌতে ফিরে আসেন। এরপর কলকাতা থেকে তার অসুস্থ মাকে লখনৌতে নিয়ে আসেন। এ বছরই তার মা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯২৬ সালে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের নির্ধারিত সভাপতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়লে অতুলপ্রসাদ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৩ সালে এলাহাবাদ লিবারেল পার্টির উত্তরপ্রদেশ শাখার অষ্টম অধিবেশনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৪ সালের ১৫ এপ্রিলে পুরী যান। গান্ধী (মহাত্মা) এই সময় পুরীতে আসেন। গান্ধীজীর অনুরোধে অতুলপ্রসাদ তাকে গান গেয়ে শোনান। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রভাববলয়ের মধ্যে বিচরণ করেও যারা বাংলা কাব্যগীতি রচনায় নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হন, অতুলপ্রসাদ ছিলেন তাদের অন্যতম। সমকালীন গীতিকারদের তুলনায় অতুলপ্রসাদের সঙ্গীতসংখ্যা সীমিত হলেও তিনি বাংলা সঙ্গীত-জগতে এক স্বতন্ত্র আসন লাভ করেন। তার গানগুলি অতুলপ্রসাদের গান নামে প্রতিষ্ঠা পায়। বাংলা সঙ্গীতে অতুলপ্রসাদই প্রথম ঠুংরির চাল সংযোজন করেন। এ ছাড়া রাগপ্রধান ঢঙে বাংলা গান রচনা তার থেকেই শুরু হয়। ছোটবেলায় ঢাকা ও ফরিদপুরে বাউল, কীর্তন ও মাঝি-মাল্লাদের  ভাটিয়ালি গানের মূর্ছনা অতুলপ্রসাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন লাভ করেছিল। সে সুরের অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত তার বাউল ও কীর্তন ঢঙের গানগুলিতে বাংলার প্রকৃতিকে খুঁজে পাওয়া যায়। অতুলপ্রসাদ প্রেম, ভক্তি, ভাষাপ্রীতি, দেশপ্রেম প্রভৃতি বিষয়ভিত্তিক বহু গান রচনা করেছেন। ১৯১৬ সালে লখনৌতে সর্বভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবকদের অধিনায়ক হিসেবে তিনি যে দেশাত্মবোধক গানটি রচনা করেন, তাতে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের সুর আছে ‘দেখ মা এবার দুয়ার খুলে/ গলে গলে এল মা/ তোর হিন্দু-মুসলমান দু ছেলে’। ‘মোদের গরব, মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা’ মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ ফুটে ওঠা গানটির আবেদন আজও অম্লান। এভাবে বাণীপ্রধান গীতি রচনা, সুললিত সুর সংযোজন, সুরারোপে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রচলন ও করুণরস সঞ্চারের মাধ্যমে অতুলপ্রসাদ বাংলা সঙ্গীতভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অসম্ভব দানশীল অতুলপ্রসাদ জীবনের উপার্জিত অর্থের অধিকাংশই ব্যয় করেছিলেন জনকল্যাণে। এমন কী তিনি তার বাড়িটিও দান করে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার লেখা সমস্ত গ্রন্থের স্বত্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে দান করে যান। গানের জন্য চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে রইবেন অতুল প্রসাদ সেন ।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৭/টিপু