সাতসতেরো

বাংলা লাইনোটাইপের ৮২ বছর

হাসান মাহামুদ : প্রযুক্তির উৎকর্ষের বদৌলতে গত দুয়েক শতাব্দিতে মুদ্রণশিল্পের অগ্রগতি হয়েছে ঈর্ষণীয়। আজ থেকে আনুমানিক আড়াইশ’ বছরেরও কম সময় আগে চার্লস উইলকিন্স আর পঞ্চানন কর্মকার মিলে ছাপাখানার প্রথম বাংলা হরফ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এখন ভাবলে মনে হতে পারে হাজার বছর আগের কথা বলা হচ্ছে। কারণ, মুদ্রণশিল্প এতোটাই এগিয়ে গেছে যে, মাত্র এক যুগ আগের মুদ্রণকেও আমরা এখন প্রাচীনকালের বলে মন্তব্য করে ফেলি। যদিও প্রাচীনকাল মানে কয়েকশ’ বছর আগের সময়কাল। এভাবে বলার কারণ, মুদ্রণশিল্পের দ্রুতগতিতে উন্নয়ন ও অগ্রগতি। আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রে ছাপানো নতুন বইয়ের সমারোহ বইমেলায় দেখে বিস্মিত এবং আনন্দিত না হয়ে পারা যায় না। বইয়ের বিষয়বস্তু যাই হোক, মান যেমনই হোক, মুদ্রণের সৌন্দর্য দেখে অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেই হয়। তবে এই অগ্রগতি হয়েছে ধাপে ধাপে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুদ্রণযন্ত্রটি স্থাপিত হয় ১৫৫৬ সালে, গোয়ায়। কাজটি করেন পর্তুগিজরা। ১৫৬৭ সালে গোয়ার ছাপাখানা থেকে এ অঞ্চলের প্রথম বই ছেপে বের হয়। খ্রিস্টান মিশনারিরা তাঁদের ধর্মীয় ভাবনা বিভিন্ন প্রকাশনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতেন। বাংলাপিডিয়া অনুসারে, এরপর ১৬৭০ সালে বোম্বে’তে মুদ্রণ প্রযুক্তি চালু হয়। ইউরোপীয় মিশনারিদের প্রচেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চালু হয় ছাপাখানা। এই সকল ছাপাখানার অধিকাংশই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে স্থাপিত হতে থাকে। পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকরা লিসবন থেকে রোমান হরফে বাংলা বই ছাপিয়ে আনেন। সবচেয়ে পুরাতন বাংলা মুদ্রণের নমুনা পাওয়া গেছে ১৬৮২ সালে প্যারিসে মুদ্রিত একটি গ্রন্থে। এসব বাংলা মুদ্রণ ছিল তামার পাতে, তখনও বাংলা অক্ষর ঢালাইয়ের কোন ব্যবস্থা হয়নি। মুদ্রণের জন্য বাংলা অক্ষরের নকশা প্রথম প্রস্তুত করেন চার্লস উইলকিন্স। তাঁর ডিজাইনকৃত অক্ষরে ছাপা হয় নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড রচিত A Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮) গ্রন্থটি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা উইলকিন্স ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। প্রথম দফায় উইলকিন্স যে টাইপ নির্মাণ করেন তাকে পরবর্তী সময়ে পঞ্চানন কর্মকার আরও মার্জিত করে উন্নতমানের টাইপ নির্মাণ করেছিলেন। উইলকিন্সের সহকারী পঞ্চানন কর্মকার ছিলেন বাংলা টাইপ খোদাই করতে জানা প্রথম বাঙালি। বাংলা টাইপকে আরও উন্নত করে লাইনো টাইপে উন্নীত করার কৃতিত্ব সুরেশচন্দ্র মজুমদারের। বিশ শতকের গোড়ার দিকে লাইনো-এর বাংলা অক্ষর বিন্যাস মনোটাইপ, ইস্টার্ন টাইপ এবং টাইপ রাইটার-এ বাংলা অক্ষর বিন্যাসে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। উনিশ শতকে ছেনিকাটা ফিক্সড টাইপ দিয়ে বই ছাপা হতো আর ছবি ছাপার জন্য ব্যবহৃত হতো কাঠে খোদাই ব্লক। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী উন্নতমানের ছবি ছাপার কৌশল উদ্ভাবন করেন। এসব পদ্ধতির মধ্যে ছিল ষাট ডিগ্রি স্ক্রিন, ডায়াফ্রাম পদ্ধতি, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, ডায়োটাইপ ও রিপ্রিন্ট। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ১৮৮৫ সালে ইউরোপীয় কোম্পানি নামে ব্লক তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৫ সালে এর নাম দেওয়া হয় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স। কাঠের পরিবর্তে তামা ও দস্তার পাতে খোদাই করে ছাপলে সেই ছাপা অনেক উন্নতমানের হয়- এটি বুঝতে পেরে উপেন্দ্রকিশোর অন্ধকার ঘরে বসে তা পরীক্ষা করে দেখতেন। অন্ধকার ঘরে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ লক্ষ্য করে তিনি হাফটোন ব্লক তৈরির সূত্র উদ্ভাবন করে স্ক্রিন তৈরির নকশা করেন। ১৮৪৭-৪৮ সালে রংপুরে প্রথম ছাপাখানা বার্তাবহ যন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বপ্রথম একজন ইংরেজ আলেকজান্ডার ফারবেখ ঢাকায় ছাপাখানা স্থাপন করেন। ছাপাখানাটির নাম ছিল ‘ঢাকা প্রেস’। এই ছাপাখানাটিতে অবশ্য বাংলা মুদ্রণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। এখান থেকে ঢাকা নিউজ নামে ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। ১৮৬০ সালে বাংলা প্রেস বা বাংলা যন্ত্র নামে ঢাকায় দ্বিতীয় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ছাপাখানাটি প্রথমদিকে শুধু বাংলা মুদ্রণের কাজ করত। ১৮৬৬ সালে ঢাকায় তিনটি ছাপাখানা ছিল। আর একটি প্রাচীন ছাপাখানা ছিল ফরিদপুরে এবং সেখান থেকে বাংলা অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশিত হতো। আজ থেকে ঠিক ৮২ বছর আগে ১৯৩৫ সালের আজকের দিনে (২৯ সেপ্টেম্বর) ছাপাখানায় প্রথম বাংলা লাইনোটাইপ ব্যবহৃত হয়। মুদ্রণের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছিল মোনো টাইপ আর লাইনো টাইপের দৌলতে। মোনো টাইপে একেকটা শব্দ আস্ত একটা ধাতব ব্লকে তৈরি হতো। একে পরিবর্তন অথবা শুদ্ধ করতে হলে পুরো শব্দটাকেই নতুন করে তৈরি করতে হতো। আর লাইনো টাইপে ছাপা হতো পুরো একটা লাইন ধরে। কোনো পরিবর্তন করতে হলে পুরোটা লাইনই নতুন করে বানাতে হতো। প্রথম মোনো টাইপ অথবা লাইনো টাইপের অক্ষরবিন্যাস অথবা অক্ষরগুলো কে তৈরি করেছিলেন, সে তথ্য জানা যায়নি। ঢাকার ‘ইডেন প্রেসে’ সর্বপ্রথম বাংলা লাইনো টাইপ মেশিন স্থাপিত হয়েছিল। মনোটাইপ মেশিন স্থাপিত হয়েছিল ‘প্যারামাউন্ট প্রেস’ ও ‘বলিয়াদি প্রেসে’। তারা মনো সুপার কাস্টিং মেশিন বসিয়ে তাতে তৈরি নানা ধরনের ইংরেজি-বাংলা টাইপ অন্যান্য প্রেসের কাছে বিক্রি করত। পঞ্চাশের দশক থেকে যেসব প্রেস উন্নতমানের মুদ্রণের জন্য খ্যাতি লাভ করেছিল সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আলেকজান্ডার মেশিন প্রেস’, ‘স্টার প্রেস’, ‘জিনাত প্রেস’ ইত্যাদি। পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে পুস্তক ও পত্রপত্রিকা মুদ্রিত হতো প্রধানত লেটার প্রেসে। সে জন্য ছবি মুদ্রণের জন্য ব্লকের প্রয়োজন হতো। লাইন ব্লক অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারিগররা হাতে তৈরি করতেন। হাফটোন ব্লকের জন্য প্রয়োজন হতো ক্যামেরা ও স্ক্রিনের, সেই সঙ্গে দক্ষ কারিগরের। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এই কাজে সবচেয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠান ছিল লিঙ্কম্যান, ইস্ট অ্যান্ড প্রসেস ও স্ট্যান্ডার্ড ব্লক কোম্পানি। প্রায় একই সময়ে অফসেট প্রেস স্থাপন করে সেকালের ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি প্রেস ও পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেস। মুদ্রণশিল্প সমিতির হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে মাঝারি ও ছোট আকারের ছাপাখানার সংখ্যা প্রায় ৮০০। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় মুদ্রণ প্রযুক্তিবিষয়ক দেশের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট। এখানে মুদ্রণের প্রাথমিক স্তরের মুভেবল টাইপ, লাইনো টাইপ মেশিন ও লেটার প্রেস, গ্যালারি টাইপ ক্যামেরা থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তির অফসেট লিথোগ্রাফি, গ্র্যাভিউর, স্ক্রিন প্রিন্টিং, অত্যাধুনিক প্রসেস ক্যামেরা (হরাইজন্টাল ও ভার্টিক্যাল), অটোপ্লেট প্রসেসর, লিথো ফিল্ম, প্যানক্রোমাটিক ফিল্ম প্রযুক্তিসহ উন্নত ধরনের মেকানিজম সংযোগ করা হয়েছে। বর্তমানে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে কম্পিউটার মুদ্রণ কৌশলবিষয়ক নতুন কারিক্যুলাম প্রবর্তন করা হয়, যেখানে ইমেজ সেটার, ড্রাম স্ক্যানার, ফ্ল্যাটবেড স্ক্যানার, লেজার প্রিন্টার, ইনক জেট প্রিন্টারসহ আধুনিক মুদ্রণপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। ঊনিশ শতকের আশির দশকে মুদ্রণশিল্পে অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। সিসার হরফের বদলে এসেছে কম্পিউটারের ব্যবহার। কম্পিউটারে বাংলা অক্ষর বিন্যাসের জন্য কয়েকটি ভিন্ন ধরনের কি-বোর্ড আছে। কম্পিউটারে বাংলা হরফ সংযোজন করার কৃতিত্ব বেশ কয়েকজনের। ১৯৮৪ সালে সর্বপ্রথম সাইফ-উদ-দোহা শহীদ বাংলা হরফের ডিজাইন করেন অ্যাপল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের জন্য। ১৯৮৬ সালে মাইনুল আরেক ধাপ অগ্রসর হয়ে বাংলা হরফের ডিজাইন করেন। ১৯৯৪ সালে মোস্তাফা জব্বার  অ্যাপল ম্যাকিনটোশ কম্পিউটারের জন্য কি-বোর্ডে বাংলা হরফ বা ফন্ট তৈরি করেন এবং নতুন এই কি-বোর্ডের নাম বিজয় কি-বোর্ড আর ফন্টের নাম দেন তন্বী, সুতন্বী। পরবর্তীকালে তিনি আইবিএম কম্পিউটারের জন্য বিজয় বাংলা সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্পে এ সফটওয়্যার ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিগত চার দশকে আমাদের দেশে মুদ্রণ শিল্পের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। কম্পিটারে কম্পোজ করা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ধাপ বাইন্ডিং পর্যন্ত মুদ্রণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া একই ছাদের নিচে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। সময়ের সাথে মুদ্রণকৌশলের আধুনিকায়ন হয়েছে। নতুন নতুন মেশিনারি আসছে। দিনে দিনে আমাদের মুদ্রণ মান উন্নত হচ্ছে। তবে যেহেতু প্রধান কাঁচামাল কাগজের বেশ বড় একটা অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, তাই এখনো যথেষ্ট সুলভ হয়ে উঠতে পারেনি মুদ্রন মূল্য। আমাদের দেশে মুদ্রণ শিল্পের সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। বলতে গেলে আমরা এখনো সম্ভাবনার সামান্যই অর্জন করতে পেরেছি। এই শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সুদূর প্রসারী বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা দরকার। পাশাপাশি রাস্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও জরুরি। বর্তমানে এই শিল্পে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশে প্রিন্ট করে তা বিদেশেও রপ্তানি করছি। এটি খুবই ইতিবাচক লক্ষণ। আশা করা হচ্ছে, আগামীতে গার্মেন্টস, পর্যটনের মতো খাতেও মুদ্রণ শিল্প ভালো অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। এটিও হবে আমাদের একটি অন্যতম বৈদেশিক অর্থ আয়ের খাত। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ