সাতসতেরো

জসিম মণ্ডল : শ্রমিক-মেহনতী মানুষের নেতা

দীপংকর গৌতম : আমি পারিবারিকভাবেই ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। কলেজে পড়ার সময় এরশাদের স্বৈরশাসন চলছে। আমরা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে জনসভা সফল করতে জেলা শহরে গেলাম। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, সাইফদ্দিন আহমেদ মানিক, মনজুরুল আহসান খান বা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বা বড় কোনো নেতাকে এবার সামনাসামনি দেখব। কিন্তু নিরাশ হলাম। কারণ মঞ্চে উপবিষ্ট পাওয়ারফুল চশমা পরা নিশ্চুপ মানুষটি আমার পরিচিত না। ছবি দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। সিনিয়র নেতাদের অভিযোগের সুরে বললাম, ভালো একজন নেতা আনতে পারলেন না?

তারা বললেন, আস্তে বলো, কমরেড শুনে ফেলবেন। তিনি অনেক বড় নেতা, ত্যাগী ও বিপ্লবী। অগ্নিযুগে ইংরেজদের কাঁপন জাগানো নেতা। চুপ করে থাকলাম। জনসভা শুরু হলো। শুনলাম তার বক্তৃতা। শ্রমিক-মেহনতী মানুষের সরল ভাষায় কঠিন শব্দগুলো বলে যেতে লাগলেন। তার কথা শুনতে গোপালগঞ্জ শহর সেদিন থমকে গিয়েছিল। বিপ্লবী জসিম মণ্ডল বলতে লাগলেন: ‘দেশ ঘুরে গোপালগঞ্জে আসলাম, পথের দুধারে দেখলাম লঙ্গল মার্কার ছবি আঁকা আর নিচে লেখা অমুক ভাইকে খেদমত করার সুযোগ দিন, তমুক ভাইকে খেদমত করার সুযোগ দিন। আমি একটু করজোরে ওইসব খেদমত আলীদের কাছে শুনতে চাই, দ্যাশে যখন দুর্দিন থাকে তখন তোমরা খেদমত আলীরা কোথায় থাকো?’

তিনি বলেছিলেন, কোনো শালার ব্যাটা নেই যে, গরিবকে না ঠকিয়ে বড়লোক হতে পেরেছে। এ অঙ্ক কঠিন এক অঙ্ক। এ অঙ্ক আপনাকে বুঝিতেই হইবে। সেদিন এ বক্তব্য শোনার মধ্য দিয়ে তার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে যাই। কত সহজ-সরল জীবন পালনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি, কত কম চাহিদার মানুষ ছিলেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারলে আর কিছু তার লাগত না। ইংরেজ থেকে শুরু করে এরশাদকে তাড়ানো- কোনো সংগ্রামেই তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। তিনি সোচ্চার ছিলেন। তার বক্তৃতা শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ফলে তার কথাগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরত। তিনি বলতেন: ‘ভায়েরা শুনে রাখেন, দোয়া-দরুদ পড়ে, আবেদন-নিবেদন করে, পীর সাহেবের পানি পরা খেয়ে, গলায় তাবিজ বেঁধে, প্রেম-পিরিতি করে, কোনো শালার অবস্থা এক ইঞ্চিও পরিবর্তন হইবে না..! ধনী লোক, গরিব লোকরে না ঠকালে, মালিকরা শ্রমিকদের না ঠকালে, পয়সা কম না দিলে, কোনো শালা বড়লোক হতে পারিবে না..! ইহার নাম বিজ্ঞান, ইহার নাম অঙ্ক, ইহা আপনাকে বুঝিতেই হইবে, তা না হইলে জোড়াতালি দিয়া, আবেদন-বিনেদন করিয়া- আপনার অবস্থার এক চুলও পরিবর্তন হইবে না, লিখিয়া রাখিতে পারেন..।’ তিনি লাল বই পড়েননি, পড়ার দরকার হয়নি। মেহনতী মানুষের জীবন দেখে জীবনের রেলগাড়ি ঠেলে যে বুদ্ধি সঞ্চয় করেছিলেন তা দিয়ে তিনি রাজনীতির মহীরুহে পরিণত হয়েছেন। কমরেড জসিম মণ্ডলের মৃত্যুতে তার সম্পর্কে যারা জানতেন তারা সবাই শোকস্তব্ধ। তার রাজনৈতিক কৌশল দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়েছেন। সবহারা মানুষ জীবন সংগ্রামের প্রেরণা পেয়েছেন। তাই সবার শোক আজ পাথরের মতো। ঈশ্বরদী থেকেও এই মহান মানুষটি জাতীয় রাজনীতির খবর রাখতেন। জীবনের সব পর্যায়ে অবদান রেখেছেন এই শহরে থেকেই। মেহনতী মানুষের ভেতর থেকে উঠে আসা কমরেড জসিম মণ্ডল কমিউনিস্ট পার্টির শুরু থেকে আমৃত্যু ছিলেন নিবেদিত এক নেতা। জীবনে ক্ষমতা, লোভ-মোহের উর্ধ্বে থেকেছেন। অন্যায় সুবিধা কখনো তার অভিধানে ছিল না। নিষিদ্ধ সময়ে রাজনীতি করেছেন। নির্যাতিত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়েই রাজনীতিতে সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগের নজির রেখেছেন। বর্ষীয়ান এই নেতার মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা পূরণ হবার নয়। কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল ১৯২২ সালে তৎকালীন নদীয়া জেলার দৌলতপুর থানার কালিদাসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম হাউস উদ্দিন মণ্ডল রেলওয়েতে চাকরি করার সুবাদে বাংলাদেশ-ভারতসহ বিভিন্ন এলাকায় তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে। ব্যক্তিজীবনে এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ের বাবা তিনি। ছেলে বছর দেড়েক আগে মারা গেছেন। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি জসিম মণ্ডলের স্ত্রী জাহানারা খাতুন মারা যান। বাবার চাকরির সুবাদে ঈশ্বরদীর একটি বিদ্যালয়ে স্কুলজীবন শুরু হয় জসিম মণ্ডলের। ঈশ্বরদীর সাড়া মারোয়ারী উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা হাউস উদ্দিন মণ্ডল বদলি হন শিয়ালদহে। শিয়ালদহে গিয়ে আর পড়ালেখা হয়নি তার। সেখানকার নারিকেলডাঙ্গা রেল কলোনিতে বসবাসের সময় মিছিল-মিটিং দেখতে দেখতেই রাজনৈতিক দীক্ষা গ্রহণ করেন। মাত্র ১৩-১৪ বছর বয়সে কয়েক বন্ধু মিলে আড্ডা দেওয়ার সময় ট্রাম শ্রমিকদের মিছিলে যাওয়ার ডাক পান তিনি। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে একদিন ব্যানার ধরে মনুমেন্ট দেখতে যান জসিম উদ্দিন। সেখানে গিয়ে অনেক কথার মধ্যে তার ভালো লাগে গরিবের পক্ষে ও ধনীদের বিরুদ্ধে বলা কথা। তখন মুসলিম লীগের মিছিল ভালো না লাগায় তিনি লাল ঝাণ্ডার মিছিলে যেতেন প্রায়ই। একদিন ওই মনুমেন্টে শুনলেন ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। ভালো লাগে তার। মিছিলের বড় ভাইয়েরা কিছু হ্যান্ডবিল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন গোপনে বিলি করতে। এভাবেই শুরু হলো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। রাজনৈতিক জীবনে তার মা জহুরা খাতুন ও সহধর্মিণী জাহানারা খাতুন নানাভাবে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৪০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন তিনি। তার পরপরই রেলওয়ের চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত চাকরির পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির স্কুলে ক্লাস করতেন। চাকরি জীবনে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পাকিস্তান ধনী লোকের জন্য, আমাদের জন্য না। ফলে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে থাকেননি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তার বাবা ঈশ্বরদীতে আবার বদলি হয়ে আসেন। ওই সময়ে পাকিস্তান সরকার রেলশ্রমিকদের রেশনে খুদ দিত। তিনি এর প্রতিবাদ করেন। মাকে সঙ্গে নিয়ে সংগঠিত হন। শুরু হয় খুদবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনে তত্কালীন রেল রোড ওয়ার্কার ইউনিয়নের সভাপতি বীরেন দাশগুপ্ত ও সাধারণ সম্পাদক জ্যোতি বসু সহমত প্রকাশ করেন। আন্দোলন যখন তুঙ্গে সেই সময়ে জসিম মণ্ডলকে বদলি করে দেয় রেল বিভাগ। এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে তার মা মারা যান। জসিম মণ্ডল ঈশ্বরদী এসেও আন্দোলন চলিয়ে যান। তারা বন্ধ করে দেন পুরো যোগাযোগব্যবস্থা। ফলে পুলিশ খুঁজতে থাকে। এ সময় জসিম মণ্ডল পালিয়ে যান। কিন্তু তাদের আন্দোলন সফল হয়। এ প্রসঙ্গে জসিম মণ্ডল নিজেই বলেছেন: ‘আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ও হুলিয়া জারি হলে নয় মাস কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে আবার ফিরে আসি ঈশ্বরদী। পরে আকবর নাম ধারণ করলেও পুলিশ আমাকে চিনে ফেলে। গ্রেফতার করে নিয়ে পাবনা কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সেদিন ছিল ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। রেল স্ট্রাইক, রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন মামলা দেওয়া হয় আমার নামে। জেলখানায় নিচু মানের খাবার নিয়েও আন্দোলন শুরু করি। কারাগারে দেখা হয় পাবনার বিশিষ্ট বাম আন্দোলনের নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা, রণেশ মৈত্র, প্রসাদ রায়সহ কয়েকজনের সঙ্গে। জেলখানায় আন্দোলনের ফলে এক মাস ঘানি টানার শাস্তি দেয় জেল কর্তৃপক্ষ। ঘানি টানার বিরুদ্ধে কথা বলা ও জেল কর্তৃপক্ষের বকাবকির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে আমাকে উলঙ্গ করে মাঘের শীতে ঠাণ্ডা পানির মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। খবর পেয়ে আমার স্ত্রী তৎকালীন জেলা প্রশাসককে অবহিত করলে তিনি জেল পরিদর্শনে এসে আমাকে উলঙ্গ দেখতে পান। এ সময় তিনি পোকাওয়ালা সিদ্ধ ছোলা খাবার দেওয়া, ঘানি টানাসহ সব বন্ধ করে দেন। ওই সময় থেকে আজ পর্যন্ত পাবনা কারাগারে আর কখনো ঘানি টানানো হয়নি কয়েদিদের দিয়ে। আমার এই আন্দোলনও সফল হয়। এরপরই আমাকে পাবনা কারাগার থেকে রাজশাহীতে বদলি করা হয়। এভাবে সাত বছর কারাবরণ শেষে বের হয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য রেল কর্তৃপক্ষের কাছে গেলে তারা আমাকে লিখিত দিতে বললে আমি অস্বীকার করলে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। তখন আমার স্ত্রীর পক্ষে এক ছেলে ও পাঁচ মেয়ে নিয়ে সংসার পরিচালনা করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়ে।’ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কমিউনিস্টরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সব সময়ই আমরা লড়াই করেছি, এমনকি কখনো পাকিস্তানকে মেনে নিইনি আমরা। আর বর্তমান সরকার আমাদের বলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি, এটা ভুল। আমরা ভারতের কলকাতা, দিল্লি, আগ্রা, শিয়ালদহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অর্থ, খাবার, পোশাকসহ বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছি। এ সময় আমার সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ দত্ত ছিলেন।

বেশ কিছুদিন অসুস্থ অবস্থায় থেকে আজ ভোর ৬ টায় জসিম মণ্ডল নিরন্তরের পথে যাত্রা করেন। এই দেশপ্রেমীক বিপ্লবীর জীবন ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। লাল সালাম কমরেড। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ অক্টোবর ২০১৭/তারা