সাতসতেরো

হীরালাল সেন, উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ

রুহুল আমিন : উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেনের শততম প্রয়াণবার্ষিকী আজ। এই বাঙালি চিত্রগ্রাহককে উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন গণ্য করা হয়। হীরালাল সেন ১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর প্রয়াত হন।তিনি উপমহাদেশের সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপনবিষয়ক চলচ্চিত্র এবং প্রথম রাজনৈতিক ছবিরও নির্মাতা তিনি ।শততম প্রয়াণবার্ষিকীতে চলচ্চিত্রের এই পথিকৃৎকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।  হীরালাল সেনের জন্ম ১৮৬৬ সালে মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে ।তার বাবার নাম চন্দ্রমোহন সেন ও মা বিধুমুখী। তার দাদা গোকুলকৃষ্ণ মুনশি জমিদার ছিলেন। ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে তাদের বাড়ি ছিল। এ ছাড়া গোকুলকৃষ্ণ মুনশি ঢাকা জজ আদালতের নামকরা আইনজীবী ছিলেন।। পরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে হীরালাল ছিলেন দ্বিতীয়। মানিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। একই সঙ্গে মৌলভীর কাছে ফারসী ভাষাও শিখেন তিনি। ১৯৭৯ সালে মাইনর পরীক্ষা পাস করে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। পরে বাবার সঙ্গে হীরালাল কলকাতা গিয়ে কলেজে ভর্তি হন। আইএসসি অধ্যয়নকালে চলচ্চিত্রের প্রতি ভীষণ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন । ১৮৯০ সালের মধ্যে মানিকগঞ্জ ও কলকাতায় ফটোগ্রাফিক স্টুডিও খোলেন। নাম ছিল ‘অমরাবতী ফটো আর্টস অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘এইচ এল সেন অ্যান্ড ব্রাদার্স’। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার ছোট ভাই মতিলাল সেন ও দেবকীলাল সেন। হীরালাল ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৮ সালের মধ্যে ফটোগ্রাফি চর্চায় শ্রেষ্ঠত্বের জন্য সাতবার স্বর্ণপদক লাভ করেন। হীরালাল সেন যখন ফটোগ্রাফি নিয়ে মাতামাতি করছেন, সে সময় (১৮৯৫ সালের শেষ দিকে) বিজ্ঞানের অষ্টম বিস্ময়কর আবিষ্কার চলচ্চিত্র বা সিনেমা বা বায়োস্কোপ চালু হয় ফ্রান্স ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে। তার মাত্র কয়েক মাস পর ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই মুম্বাইয়ের হোটেল ওয়াটসনে চলচ্চিত্র দেখানো হয়। নতুন এই আকর্ষণীয় মাধ্যম উপমহাদেশে হই চই ফেলে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তা কলকাতা, লাহোর, মাদ্রাজ ও ঢাকায়ও দেখানো হয়। ১৮৯৭ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় টমাস হাডসন ও আর্থার সুলিভান এবং পরের বছর স্টিভেনশন চলচ্চিত্র দেখান। হীরালাল তখন এই চলচ্চিত্র দেখে অভিভূত হন এবং নিজে তা প্রদর্শন ও নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহী ও উদ্যোগী হন। তিনি স্টিভেনশন ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার ল্যাফোঁর সহায়তায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যাপারে জ্ঞানলাভ করেন।পরে বিদেশ থেকে প্রজেক্টর ও চলচ্চিত্র আমদানি করে তা দেখাতে শুরু করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি অমর দত্তের সহায়তায় ক্লাসিক থিয়েটার ও মিনার্ভা থিয়েটার, ভোলার এসডিওর বাংলো এবং নিজগ্রাম বগজুরীর বাড়িতে চলচ্চিত্র দেখান। পরবর্তীকালে তিনি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য ‘দি রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ গঠন করেন । এর মাধ্যমে তিনি বিভিন্নস্থানে বায়োস্কোপ দেখান। চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে গিয়ে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আগ্রহী হন। ১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি লন্ডন থেকে মুভি ক্যামেরা আমদানি করেন। এই ক্যামেরা দিয়ে প্রথমে মানিকগঞ্জের গ্রামে শুটিং করেন। এই সময় তিনি ‘পুকুরে স্নান’ ও ‘কোটের খেলা’ নামে দুটি স্বল্পদৈঘ্য চিত্র নির্মাণ করেন। এগুলো কলকাতায় দেখানো হয়। এভাবে শুরু হয় হীরালাল সেনের চলচ্চিত্র নির্মাণ, পরিকল্পনা ও প্রযোজনার অভিযাত্রা। ১৯০১ সালে তিনি কয়েকটি জাতীয় নাটকের নির্বাচিত মঞ্চদৃশ্যের চিত্র ধারণ করেন। এটি ৯ ফেব্রুয়ারি ক্লাসিক থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়। এসব চিত্রের মধ্যে ছিল হরিরাজ, দোললীলা, সরলা, বুদ্ধচরিত, সীতারাম ও ভ্রমর। হীরালাল সেনের কর্মজীবন ব্যাপ্ত ছিল ১৯১৩ অবধি। এই সময়ের মধ্যে তিনি চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। বেশিরভাগ ছবিতেই তিনি ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ বিভিন্ন দৃশ্য ধারণ করেন। সেই সময় ফিল্ম আনা হত বিদেশ থেকে। তার নির্মাণ করা ছবির মধ্যে ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ ("Alibaba and the Forty Thieves")ছবিটি ছিল পূর্ণদৈর্ঘ্যের। ১৯০৩ সালে নির্মাণ করা এই ছবিটিও বানানো হয়েছিল ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনীত একই নামের থিয়েটারের ওপর ভিত্তি করে।বাণিজ্যিকভিত্তিতে তিনি কতকগুলি বিজ্ঞাপন বিষয়ক আর কিছু সংবাদমূলক চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন।তিনি ‘জবাকুসুম হেয়ার অয়েল’ আর ‘এডওয়ার্ডস টনিক’ এর ওপর বিজ্ঞাপনচিত্র বানিয়েছিলেন। হীরালালের তৈরি তথ্যছবি ‘Anti-Partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town Hall, Calcutta on 22nd September 1905’ ভারতের প্রথম রাজনীতিক চলচ্চিত্র বলে গণ্য করা হয়।১৯০৫-এর ২২শে সেপ্টেম্বর কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি প্রতিবাদ সভা হয়েছিল, এ ছবিতে তা-ই ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। এ ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল- ‘আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা’। ছবির শেষে গাওয়া হয়েছিল ‘বন্দে মাতরম’। তার প্রতিষ্ঠিত রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি প্রথম ছবি বানায় ১৯১৩ সালে। এরপর হীরালাল অনেক দুর্গতি আর অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হন। এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানি তার থেকে অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করেন। এর ওপর হীরালাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক অগ্নিকাণ্ডে তার তৈরি সমস্ত ছবি নষ্ট হয়ে যায়। হীরালাল সেন হেমাঙ্গিনী দেবীকে বিয়ে করেন।তাদের তিন সন্তানের কথা জানা যায়। প্রথম ছেলে বৈদ্যনাথ সেন ১৯০২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তৃতীয় সস্তান মেয়ে প্রতিভা সেন তথির বিয়ে হয় নরনাথ সেনের সঙ্গে। নরনাথ সেনের ভাইপো দিবানাথ সেনের স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্র সেন। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ অক্টোবর ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু