সাতসতেরো

বাংলায় প্রথম লোককাহিনী সংগ্রাহক রেভারেন্ড লালবিহারী

হাসান মাহামুদ : দীনবন্ধু মিত্র তার সুরধুনী কাব্যে লিখেছিলেন, ‘খৃষ্টধর্ম অবলম্বী ধর্ম সুধাপান/ অভিলাষী দিবানিশি দেশের কল্যাণ’। কথাগুলো তিনি লিখেছিলেন খৃস্টধর্মকে সম্মান জানিয়ে এবং কথিত আছে রেভারেন্ড লালবিহারী দে’কে উদ্দেশ্য করে। লালবিহারী দে ছিলেন একজন ভারতীয় খ্রীস্টান, ‍যিনি বাংলার গ্রামীণ জীবনের প্রথম মরমী অনুসন্ধান করেছিলেন । বাঙালির নবজাগরণের অগ্রপথিক রাজা রামমোহন বাঙালির সমাজ ও ধর্মসংস্কার ও শিক্ষার যে আলোক বর্তিকা প্রজ্জ্বালন করেছিলেন তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন ঊনিশ শতকের কয়েকজন কৃতি পুরুষ। তাদের মধ্যে অন্যতম রেভারেন্ড লালবিহারী দে। তিনি লেখক ও বহুখ্যাত ভারতীয় খ্রিস্টান পণ্ডিত। ১৮২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর বর্ধমান জেলার সোনাপলাশী গ্রামের এক সুবর্ণবণিক পরিবারে লালবিহারী দে’র জন্ম। তখনকার দিনে সামান্য ইংরেজি জ্ঞান ও ইউরোপিয়দের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক সুযোগ এনে দিত। তাই রাধাকান্ত পুত্র লালবিহারীকে কলকাতায় আলেকজান্ডার ডাফ প্রতিষ্ঠিত (১৮৩০) জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে শিক্ষালাভের জন্য পাঠান। স্কুলটি ছিল অবৈতনিক। ডাফ সাহেব পেশায় ছিলেন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। তাই তার উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব ভারতীয়দের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা। ডাফের ইনস্টিটিউশনে লালবিহারী যে ধরনের শিক্ষালাভ করেন, তা তাকে নিজধর্মের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলে এবং ১৮৪৩ সালে তিনি রেভা. কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। ১৮৫১ সালে তিনি চার্চের ধর্মযাজকরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। তার ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্র ছিল বর্ধমান জেলা। ১৮৫৫ সালে তিনি ‘রেভারেন্ড’ পদে উন্নীত হন। তিনি যদিও তরুণ বয়সেই খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, স্বদেশপ্রেমিক রূপে তার অবদান বাংলার সামাজিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। তিনি বর্ধমানের এক প্রান্তিক সুবর্ণবণিক পরিবারের সন্তান, অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে আপন অধ্যাবসায়ে ঊনিশ শতকের বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এক উজ্বল মুখ।  ১৮৬৭ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত লালবিহারী বহরমপুর কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এবং ১৮৭২ থেকে ১৮৮৮ সাল পর্যন্ত হুগলী মহসীন কলেজে ইংরাজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। বর্ধমানে কর্মরত থাকা অবস্থাতেই লালবিহারী সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। তৎকালীন বাংলার গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে লেখার এক প্রতিযোগিতা আহবান করেছিলেন উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। বিজয়ী হন লালবিহারী ‘গোবিন্দ সামন্ত’ নামে উপন্যাস লিখে। গ্রন্থটি পড়ে বিশ্বখ্যাত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন বইটির প্রকাশককে লিখেছিলেন ‘আই শ্যাল বি গ্ল্যাড ইফ ইউ উড টেল হিম উইথ মাই কমপ্লিমেন্টস হাউ মাচ প্লেজার এন্ড ইন্সট্রাকশন আই ডিরাইভড ফ্রম রিডিং আ ফিউ ইয়ার্স এগো, হিজ নভেল ‘গোবিন্দ সামন্ত’। গভীর মমতায় লালবিহারী এঁকেছিলেন গ্রাম বাংলার প্রান্তিক মানুষের জীবন। পরে ১৮৭৮ সালে এই গ্রন্থটিরই নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয় ‘বেঙ্গল পেজন্টস লাইফ’ নামে। ঊনিশ শতকে বাংলার গ্রামীণ সমাজ-জীবন, মানুষের দৈনন্দিন যাপন জানার জন্য রেভারেন্ড লালবিহারী দে’র ‘বেঙ্গল পেজন্টস লাইফ’ ঐতিহাসিক দলিলের মর্যাদা পায়। তার আগে আর কোনো বাঙালি লেখক বাংলার গ্রামীন-জীবন সম্পর্কে এমন পূর্ণাঙ্গ ও প্রামাণিক চিত্র তুলে ধরেননি। আরও একটি বিষয়ে লালবিহারী পথিকৃতের মর্যাদা পেয়েছেন। তা হল বাংলার গ্রামীণ সমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংগ্রহ। লালবিহারী তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ সংকলন ‘ফোক টেলস অফ বেঙ্গল’ এর মাধ্যমে বাংলার লোকসাহিত্যের আধুনিক অধ্যয়নের রাস্তা খুলে দেন। ‘ফোক টেলস অফ বেঙ্গল’ই বাংলার নিজস্ব লৌকিক উপকথার প্রথম সংগ্রহ। বাস্তবিকপক্ষে এর মাধ্যমে তিনি লোকসাহিত্যের আধুনিক অধ্যয়নের পথ সুগম করেন, যা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে লালবিহারী দে’র গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো দেশিয় ভাষায় শিক্ষাদান এবং বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব উত্থাপন। তিনিই প্রথম দেশিয় ভাষায় শিক্ষাদান এবং বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার এই প্রস্তাব অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির জোরালো সমর্থন লাভ করে। তিনি ‘অরুণোদয়’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন যার একটি নীতিই ছিল দেশিয় ভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করা। শিক্ষা সম্পর্কে তার এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ১৮৮২ সালের শিক্ষা কমিশনের (হান্টার কমিশন) দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। সমাজের নিম্ন শ্রেণির লোকজনদের মধ্যে শিক্ষাকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব সরকার কর্তৃক এই কমিশনের ওপর অর্পিত হয়। আধুনিকমনস্ক লালবিহারী দে প্রথম এই নির্যাতিত শ্রেণির মূল সমস্যার কারণ অনুসন্ধান করেন এবং তার সমাধানেরও পথ নির্দেশ করেন। লালবিহারী ছিলেন জমিদারি প্রথার বিরোধী। কৃষকদের দুর্দশা সম্পর্কে তার রচনাবলি তারই সমকালীন দুই প্রতিভাধর লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কিশোরীচাঁদ মিত্রের চিন্তাজগতকে প্রভাবিত করেছিল। তারা দুজনেই কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে ক্ষুরধার লেখা প্রকাশ করেন। তাদের মতামত ১৮৮০ সালের রেন্ট কমিশনের রিপোর্টকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ফলে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ল্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট কার্যকর হয়, যা বাংলার কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার ‘ম্যাগনা কার্টা’ নামে পরিচিত। একথা ঠিক যে লালবিহারী খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তার অধিকাংশ রচনাই ইংরাজিতে কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেরও গভীর অনুরাগী ছিলেন তিনি। বাঙালি হিসাবে তার গর্বের কোনো কমতি ছিল না। বাংলার সমাজজীবনের নবজাগরণকালের সেই আদিপর্বে শিক্ষা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন রেভারেন্ড লালবিহারী দে। গভীর স্বদেশ প্রেম, স্বজাতি-গর্ব, আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন চেতনা ছিল লালবিহারীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। গভীর স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সম্পাদনা করতেন ইংরেজি ভাষার পত্রিকা ‘বেঙ্গল ম্যাগাজিন’, ‘ফ্রাইডে রিভিউ’, ‘ইন্ডিয়ান রিফর্মার’। বাংলার কৃষকদের দুঃসহ অবস্থা তুলে ধরতেন বেঙ্গল ম্যাগাজিনে, পরবর্তী কালে বঙ্কিমচন্দ্র যেমন তুলে ধরতেন তার ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। লালবিহারী দে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন ধর্মীয় সংস্কার, ভাষার বাঁধা আর জাতিগত ব্যবধান। ১৮৯৪ সালের আজকের দিনে (২৮ অক্টোবর) ৭০ বছর বয়সে বাংলার রত্নপ্রসবা উনিশ শতকের সুসন্তান বিদ্বান ও জ্ঞানতাপস রেভারেন্ড লালবিহারী দে’র জীবনাবসান হয়। এই মহান মনীষীকে আমাদের শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ অক্টোবর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ