সাতসতেরো

শুধু হিংসা নয় ছিল বুদ্ধিভিত্তিক ঈর্ষা, নীলনকশা এদিনে

হাসান মাহামুদ : যদি পাইকারি হত্যাকাণ্ডকে সংবাদপত্র গণহত্যা আখ্যায়িত করে, তা অবশ্যই ভয়ঙ্কর। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে বাছাই করে জাতির সবচেয়ে যোগ্য, বুদ্ধিমান ও গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ ও নারী হত্যার মাধ্যমে যদি একটি জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, সেই ‘এলিটোসাইড’ এলিট হত্যা যে আরো বেশি ভয়ঙ্কর। কথাগুলো থেকে সহজেই ধারণা করা যায়, একটি জাতিকে ভয়ঙ্করভাবে পঙ্গু করে দিতে কতটা নির্লজ্জ চক্রান্ত করতে পারে একটি দেশ। একাত্তরে স্বাধীনতার দু’দিন পর বিজয় উল্লাসে বুদ্ধিজীবীদের অনুপস্থিতি বুঝাতে বিদেশি সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন ওপরের কথাগুলো লিখেছিলেন। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য সানডে টাইমস’ এর প্রতিবেদনে স্থান পায়। উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, নিকোলাস টোমালিন তার দু’দিন আগেই বাংলাদেশ থেকে ঘুরে যান। ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস’ শীর্ষক গ্রন্থে একটি নিবন্ধ লেখার জন্য একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তিন ঘণ্টার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিন। বিজয়ের অন্যসব অনুষঙ্গের পরিবর্তে লিখলেন বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে। সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক তিনি যে প্রতিবেদনটি তৈরি করেন তার শিরোনাম ছিল, ‘বাংলার বুদ্ধিজীবীদের লাশ ডোবায় পড়ে আছে’। টোমালিন লিখেন, বিজয়ের আনন্দে উদ্বেল মানুষের মধ্যে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে মানব ইতিহাসের ন্যক্কারজনক এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের খবর। স্তম্ভিত হয়ে পড়েন আত্মহারা মানুষ’। এই একটি বিষয় বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিকোলাস টোমালিনের মতো অবদান রয়েছে মার্ক টালি, সাইমন ড্রিং, নেভিলে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস-এর মতো এক বিদেশি সাংবাদিকদেরও। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও অন্যান্য ঘটনা পর্যবেক্ষণপূর্বক বিশ্ববাসীর কাছে সর্বপ্রথম উন্মোচিত করেন। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে লিখেন যা বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তুলতে সাহায্য করেছিল। এ বিষয় নিয়ে তিনি বইও লিখেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ এবং সংবাদ বা প্রতিবেদন তৈরির জন্য যারা যেসব বিদেশি সাংবাদিক এসেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে সংবাদ লিখেছিলেন। এমন অনেক সাংবাদিকের মতে, তাদের কাছে এই ঘটনা ছিল, একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। কারণ, পৃথিবীতে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তেমন কোনো দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। সে হিসেবে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা। বিভিন্ন ইতিহাসবিদরাও নির্ধিদ্বায়, স্বীকার করেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্তিম আঘাত। পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতিকে মেধাহীন ও পঙ্গুত্ব করতে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের বাসা এবং কর্মস্থল থেকে রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানি, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা এই সুপরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের শিকার হন। পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশনা ও মদদে এক শ্রেণির দালালরা এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ঘুরেফিরে এসেছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে জানা যায়, বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা হয়েছিল একাত্তরের আজকের দিনে (১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর)। যুদ্ধের দিনপুঞ্জিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর, চারিদিকে জয়ের আগমনী বার্তা। যৌথবাহিনীর আক্রমণে হানাদারমুক্ত হতে থাকে একের পর এক অঞ্চল। স্বগৌরবে উড়তে থাকে লাল-সবুজের পতাকা। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছিল বিজয়কে বরণ করার। টাঙ্গাইলে সারারাত যুদ্ধ শেষে এদিন ভোরে অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় হানাদারবাহিনী। ঢাকায় সামরিক অবস্থানের ওপর বেপরোয়া বিমান হামলাসহ শহরজুড়ে কারফিউ অব্যাহত থাকে। ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে নিরীহ বাঙালির ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। অন্যদিকে এ রাতে রাও ফরমান আলী এদেশীয় দোসরদের নিয়ে গোপন বৈঠকে বসে এবং শেষ আক্রমণ হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা তৈরি করে’। এদিন, মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর থেকে ২৪ ঘণ্টার দূরত্বে এসে অবস্থান নেয়। এ সময় একদিকে পাকিস্তান সমর সাহায্য পাওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, অপরদিকে যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরাজয়ের সন্নিকটে এসে নিজেদের নৃশংসতার আরো একটি ঘৃণ্য প্রমাণ দেয় বর্বর পাকবাহিনী। বাঙালির মেরুদণ্ড ভাঙতে এ রাতেই প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গোপন শলা পরামর্শ করতে তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানেই বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা চূড়ান্ত করা হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৪ ডিসেম্বর এক করুন-কঠিন সোপান, কালো দিন। দিনটি ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/সাইফ