সাতসতেরো

আজ সব্যসাচী লেখকের জন্মদিন

শাহ মতিন টিপু : সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ৮৩তম জন্মদিন আজ। ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলায় তার জন্ম। প্রিয় লেখককে আমরা হারিয়েছি গত বছর। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ৭৯তম জন্মদিনে তিনি ‘সবুজ রৌদ্রের এই পিপাসাই’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছিলেন- ‘সামান্যের জন্মদিন/তেরোশত নদীর এ দেশে সে তো নবান্নেরই দিন।’ আসলে তিনি সামান্য ছিলেন না, তিনি অসামান্য ছিলেন। আর কাজের মধ্য দিয়ে তিনি তার অসামান্যতা আমাদের দেখিয়ে গেছেন।তিনি ছিলেন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, চিত্রকর, ভাস্কর এবং আরো বহুবিচিত্র সাহিত্য-শিল্পধারার কীর্তিমান স্রষ্টা । আবার তিনি দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি ভূমিকা রেখে গেছেন। বলা যায়, তিনি জন্মেই কাব্য প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন। সেই এগারো/বারোর কিশোরকালেই টাইফয়েডে শয্যাশায়ী থেকে লিখেছিলেন- ‘আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/তাহার উপরে দু`টি লাল পাখি বসিয়া আছে।’বারো বছরের ওই কিশোরের কাব্যস্ফূর্তি দেখে অবাক হয়ে যেতেন বাবা-মা ও পাড়া-প্রতিবেশী। সেই প্রতিভাদীপ্ত কিশোর পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উজ্জ্বল তারকার মতই জ্যোতি ছড়িয়েছেন, মেধা, মনন ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তার দৃপ্ত পদচারনায় বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য উচ্চ মাত্রা পেয়েছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। আর অসম্ভব জনপ্রিয়তা নিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ও মা হালিমা খাতুন ছিলেন গৃহীনি। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিলো কুড়িগ্রামে । ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর কবিতা লিখতে শুরু করেন। লেখেন ছোটগল্পও । গল্প প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের মে মাসে ‘অগত্যা’ পত্রিকায়। সে বছরই বোম্বে চলে যান। একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে সহকারী হিসেবে বছরখানেক কাজ করেন। ১৯৫২তে ঢাকা আসেন এবং তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬তে পড়া ছেড়ে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। এর কিছুদিন পরই  পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার লেখা উপন্যাস  ‘দেয়ালের দেশ’ । এক পর্যায়ে ঝুঁকে পড়েন সিনেমার চিত্রনাট্য লেখায় । ১৯৫৯ সালে লেখেন ‘মাটির পাহাড়’ সিনেমার চিত্রনাট্য। তিনি অনেক সিনেমার কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। তার চিত্রনাট্যের প্রায় সব ছবিই সুপার হিট হয়েছে। তিনি সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। চলচ্চিত্রের জন্য গানও লিখেছেন । তার লেখা নাটক `পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়` এবং `নূরলদীনের সারা জীবন` মানুষকে যুগের পর যুগ স্পন্দিত করবে। ১৯৬৬ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারও লাভ করেন। আগেই বলেছি, তিনি সব্যসাচী। সাহিত্যের সব শাখায় দৃঢ় পদভারে সমানভাবে বিচরণ তার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। কবিতায় তিনি যুক্ত করেছেন নতুন ধারা। ১৯৭০ সালে ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’ শিরোনামে রচিত দীর্ঘ কবিতার কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। তিনি আঞ্চলিক ভাষাকেও উপস্থাপন করেছেন তার কবিতায়। বলা যায়, সৈয়দ শামসুল হক পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের জন্য পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। তার দেখাদেখি পরবর্তী সময়ে অনেকেই তাদের কবিতায় আঞ্চলিক ভাষাকে টেনে এনেছেন যা বাংলা সাহিত্যকে আরো একধাপ সমৃদ্ধ করেছে। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজ্যে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। তাঁর ভাষা আর আঙ্গিকের উজ্জ্বল নিরীক্ষার পরিচয় উৎকীর্ণ হয়ে আছে 'বিরতিহীন উৎসব', 'অপর পুরুষ', 'বৈশাখে রচিত পঙিক্তমালা', 'পরানের গহীন ভিতর'সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে। ম্যাকবেথ, টেম্পেস্ট, শ্রাবণ রাজাসহ বিশ্বসাহিত্যের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনাও তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তার নিষিদ্ধ লোবান অবলম্বনে নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু তৈরি করেছেন চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’। লেখালেখি ছাড়াও সৈয়দ হক বিবিসিতে সাংবাদিকতাসহ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চলচ্চিত্রের সাথেও যুক্ত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি মনোরোগের চিকিৎসক ও লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আনোয়ারা সৈয়দ হকও একজন প্রতিথযশা লেখক। এই দম্পতির রয়েছে এক ছেলে ও এক মেয়ে । রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ ডিসেম্বর ২০১৭/টিপু