সাতসতেরো

কালি ঝোপ ও মরিয়ম ফুল

জায়েদ ফরিদ: খোলা মরুতে জোর বাতাস বইছে। সে বাতাসে গড়িয়ে চলেছে বাতাবিলেবু আকৃতির এক ধরনের গোলাকার বস্তু। কাঁকর পাথর বালিয়াড়ি ডিঙিয়ে চলছে তো চলছেই যতক্ষণ না খাদে বা জলের কিনারে গিয়ে আটকে পড়ছে। জলে ডুবে সেই গোলক খুলে যাচ্ছে, খুলে যাচ্ছে বৃষ্টির পানিতেও। এটাই এর স্বভাব, আমাদের গল্প শোনা, স্বল্প দেখা মরিয়ম ফুলের স্বভাব। যীশুমাতা মরিয়মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে গোটা পৃথিবী একে ‘মরিয়ম ফুল’ বলে চেনে যার আচরণগত একটি ইংরাজি নাম টাম্বল্-উয়িড (Tumbleweed)। ইংরেজি টাম্বলিং শব্দের সঙ্গে আমাদের সমধিক পরিচয় ৩০০ বছরের পুরনো নার্সারি রাইমের ‘জ্যাক অ্যান্ড জিল’ ছড়া থেকে, শেক্সপিয়ারও যার উল্লেখ করেছেন কয়েক জায়গায়। বাতাসের প্রকোপে যখন ছোট মরিয়ম ফুল কিংবা কালি-ঝোপ গড়াতে থাকে তখন স্মৃতিতে কেবলই ভেসে ওঠে ক’টি শব্দ- Jack fell down and broke his crown

And Jill came tumbling after মূলত, এটাকে ফুল বলা হলেও আদতে ফুল নয়, ফুলপ্রতিম বলা যায়। বর্ষজীবী এই গাছটির ফুল হয় খুব ছোট, সাদা রঙের। গোটা গাছকেই ফুলের মতো দেখায় যখন পরিণত গাছের শাখা-প্রশাখা ভেতরের দিকে বেঁকে গিয়ে গোলকের আকার ধারণ করে। এর ভেতরের দিকে মুড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ট্রিহ্যালোসের (Trihalose) ভূমিকা যা একপ্রকার ডাইস্যাকারয়েড সুগার। বাতাসের তোড়ে শুকনো খটখটে গোলকের কাঁটা একসময় ভেঙে গিয়ে তৈরি হয় গড়ানো উদ্ভিদ, জোর বাতাসে যাদের চলমানতা দেখে মনে হতে পারে জীবন্ত কোনো পরিযায়ী প্রাণীর দল ছুটে চলেছে মরুভূমিজুড়ে।

কালি ঝোপ

আমাদের দেশে, ভারত পাকিস্তানে এমনকি মালয়েশিয়াতেও এই ফুলের একটি ভিন্ন পরিচয় আছে, যা বেশ বিস্তৃত। সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে শায়িত মায়ের পাশে ঈষদুষ্ণ গরম জলে এই মরিয়মফুল তথা মরিয়মগাছ ডুবিয়ে রাখা হয়। জলে ভিজে ক্রমশ খুলতে থাকে মরিয়ম ফুল আর প্রসূতিও মানসিকভাবে স্বচ্ছন্দ অনুভব করতে থাকেন যেন ফুল খোলার সাথে জরায়ু বিস্তৃতির একটি নৈসর্গিক যোগাযোগ আছে। এক সময় পাত্র থেকে একটু জলও পানের জন্য দেয়া হয় জন্মদায়িনীকে যার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। নানাবিধ খনিজসমৃদ্ধ এই জলে থাকে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম যা পেশী নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিছু কিছু গাছের বংশ বিস্তারের অভিনব উপায় থাকে, মরিয়ম গাছেরও এমন। পুষ্ট বীজগুলো গোলকের ভেতরে আটকে থাকে, চলমান অবস্থায় সহজে বাইরে বেরুতে পারে না। জলস্পর্শে অবয়ব খুলে যাওয়ার ফলে বীজগুলো মুক্তি পায়। পরিমিত জল পেলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গোলকের ভেতরে গজিয়ে ওঠে পত্রাবলী। দেখে ভ্রম হয়, যেন মরিয়ম গাছ পুনর্জীবিত হয়ে পাতা ছড়িয়েছে। এর বীজের একপ্রান্তে থাকে কিছুটা চামচ আকৃতির উপাঙ্গ, বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে ডাংগুলির মতো লাফিয়ে উঠে দূরে চলে যায় বীজ, যা বীজবিসরণের ঈঙ্গিতবহ একটি প্রক্রিয়া। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখার জন্য অবশ্য মানুষ থাকে না বিরাণ মরুতে। এদিকে ঊর্বরা শ্যামল বাংলায় বিসরণের লক্ষ্যে জোর বাতাসে শিমুল তুলার বীজ উড়তে থাকে বাতাসে, যেন তুলাবীজ থেকেই সৃষ্টি হয় পেঁজাতুলো সাদা মেঘ। এই বীজগুলো ভাস্পাখিদের মতো উড়তে থাকে মাইলের পর মাইল, কেউ জানে না কোন দেশে গিয়ে স্পর্শ করবে ভূমি, গজিয়ে উঠবে সকন্টক শিমুল-শিশু। মরিয়ম ফুল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যানাস্ট্যাটিকা হাইরো.চান্টিকা (Anastatica hierochuntica) যেখানে অ্যানাস্ট্যাটিকা গণের অর্থ এমন গাছ যা জলের সান্নিধ্যে পুনরুজ্জীবিত হয়। এমন গাছের সংখ্যা খুব কম। বাজারে বিক্রীত নোভেল্টি প্ল্যান্ট সেলাজিনেলা লেপিডোফিলা, এয়ারপ্ল্যান্ট টিল্যান্ডসিয়া, লাইকেন এ ধরনের গাছ। গাছের বাকল বা পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে ছত্রাক-শৈবাল মিশ্রিত মিথোজীবী লাইকেন শুকনো মড়মড়ে হয়ে পড়ে কিন্তু জলের সমাগমে আবার প্রাণ ফিরে পায়। ক্ষুদ্রাকৃতি মরিয়ম ফুলগাছের বীজ বাঁকানো ডালপালার ভেতরে বন্দী অবস্থায় থাকে কিন্তু বিশাল আকারের গড়ানো উদ্ভিদ কালি ট্রেগাসের (Kali tragus) ক্ষেত্রটা ভিন্ন। এক মিটারের মত ব্যাসের গোলাকার এই গাছ গড়িয়ে চলার পথে বীজ বোনা মেশিনের মতো বপন করে যায় অসংখ্য বীজ। একটি মাঝারি গাছে বীজের সংখ্যা দুই লাখের কম নয় যা বৈরি পরিবেশে প্রায় পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় টিকে থাকতে পারে। কালি ট্রেগাসকে রাশিয়ান থিসল্ও বলা হয় কারণ সেখান থেকেই প্রথমে আমেরিকায় এর আগম ঘটেছিল ১৮৭০ সালে, তিসি বীজের সঙ্গে। এরপর এটা ছড়াতে ছড়াতে আলাস্কা ছাড়া আমেরিকার সব স্টেটগুলোতেই ছড়িয়েছে, এখন কানাডাতেও এর উপস্থিতি জানা গেছে; দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আফ্রিকাও বাদ নেই। কালি একপ্রকার আগ্রাসী রুডেরাল প্ল্যান্ট (Ruderal plant) যা উপদ্রুত এলাকা যেমন অনুর্বর কন্সট্রাকশন সাইট, সমুদ্রতীরবর্তী নোনামাটি ও রাবিশের মধ্যে অনায়াসে জন্মাতে পারে।

টেক্সাসে কালিঝোপের কবলে বাড়িঘর

কালিকে নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনা ও কষ্টের শেষ নেই। ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আগে একে কৌতূহলদ্দীপক একটি রোলিং উইড বলে মনে হলেও এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে এর যন্ত্রণায় কিছু প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকদের বাড়িঘর পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হচ্ছে। যখন একটি একতলা বাড়ি সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে যায় কালির জমায়েতে, বাড়ির বাসিন্দারা যখন বেরুবার পথ পায় না তখন সাহায্য পাবার আশাও প্রায় অবান্তর মনে হয়, কারণ হাইওয়ের উপরে এমনভাবে এরা জমে যায় যে চক্রযানের মাধ্যমে সাহায্য পৌঁছানোর পথ সুগম থাকে না। বিল্ডিংয়ের পাশে বিশাল স্তুপে কালিঝোপ জমে গেলে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কায় লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। কালিগাছের ভেতরে থাকে ভূমি থেকে শোষিত নাইট্রেট যা তীব্র দহনে সহায়তা করে। কাঠ বা কংক্রিটের ফেন্সে এগুলো আটকে ক্রমশ এমন নিরেট হয়ে ওঠে যে বাতাসের তোড়ে ফেনস্ উলটে পড়ার অবস্থা হয়। এই কন্টকময় আগাছা গ্লাভস্ ছাড়া ধরাও যায় না, অনেকের প্রচন্ড রকম অ্যালার্জিও হতে দেখা যায়। প্রতিকারের জন্য একে জৈবনিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে আনতে পারলে ভাল, নিয়ন্ত্রিত আগুনে দহন করেও এদের দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চলছে। কালির নানাবিধ অগুণের মধ্যেও এর কিছু ভালো দিকও আছে। কালির সঙ্গে বর্তমানে আমরা পেরে উঠছি না দুর্বল পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির কারণে। যথেষ্ট খনিজসমৃদ্ধ এই গাছ থেকে দরকারী খনিজ সংগ্রহ করা একদিন হয়তো সম্ভব হবে। নষ্ট ভূমি থেকে এরা সীসা, আর্সেনিক, পারদজাতীয় বেশ কিছু ক্ষতিকর ধাতু শুষে নিতে পারে। অতএব নষ্টভূমি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কালি উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। কচি অবস্থায় এটি আকর্ষণীয় পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এমনকি শুকনো হওয়ার পরেও পানিতে ভিজিয়ে পশুখাদ্য তৈরি করা যায়। পেছনে লেজের নিচে চর্বি জমা দুম্বাজাতীয় প্রাণী এবং উট কাঁটাসহ এগুলো অনায়াসে খেতে পারে। অকজ্যালেট এবং নাইট্রেটের পরিমাণ কমাতে পারলে কালিকে ব্যবহার করা যায় মানুষের খাদ্য হিশেবেও যা রফতানির চিন্তা করা অবান্তর নয়। প্রযুক্তির বলে চূর্ণীভূত গাছ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দরকারি খনিজ পদার্থগুলো বের করে নেয়া যেতে পারে। তুরস্কে ইতোমধ্যে চূর্ণ গাছের সঙ্গে ফলের খোসা ইত্যাদি মিশিয়ে একধরণের উৎকৃষ্ট পল্লী-জ্বালানিও উদ্ভাবিত হয়েছে। বাংলাদেশ কালি-অধ্যুষিত নয়, বৃষ্টিভেজা প্রতিকূল পরিবেশে তার সম্ভাবনাও নেই, কিন্তু অন্য আগাছা রয়েছে আমাদের যার নিরাময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশও অবদান রেখে চলেছে। কালি ইতোমধ্যেই একটি প্রকট আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কালিকে কেন্দ্র করে কিছু দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হলে প্রকারন্তরে তা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির উপরেও বর্তাবে। এই গাছ নিরাময়ে জৈবনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, প্রযুক্তি আবিষ্কারের মাধ্যমে একে বর্জন করার পাশাপাশি ব্যবহারের দিকগুলোও গোটা বিশ্ববাসী ভেবে দেখতে পারে! রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ১ জুন ২০১৮/হাসনাত/তারা