সাতসতেরো

এম এ জি ওসমানীর শততম জন্মবার্ষিকী

শাহ মতিন টিপু: মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, যিনি জেনারেল এম এ জি ওসমানী নামে অধিক পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ছিলেন মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। এই মহান মানুষটির শততম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বাবা খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের কর্মস্থল সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস দয়ামীর। মা জুবেদা খাতুন। ওসমানী কেমন মানুষ ছিলেন একটি উদাহরণেই তা প্রতীয়মান। উদাহরণটি এক ফেসবুক বন্ধুর পেজ থেকে প্রাপ্ত।১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। ওই সময় প্রচারনায় তিনি মৌলভীবাজার জেলায় এসেছিলেন। বড়লেখার চান্দগ্রাম ফেরিতে পারাপারের জন্য অপেক্ষমান একটি গাড়িকে ওভারটেক করে ড্রাইভার তার গাড়িটিকে ফেরিতে উঠান। তিনি ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে তার গাড়িটিকে ফেরি থেকে নামিয়ে আনেন এবং সিরিয়ালে আগে থাকা গাড়িটিকেই যেতে দেন। ব্যক্তিজীবনে এরকমই সৎ, আদর্শবান এবং সুশৃঙ্খল ছিলেন জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। ওসমানী ১৯৩১ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। পরের বছরই তিনি সামরিক শিক্ষা শেষ করে বৃটিশ কমিশনপ্রাপ্ত হন। ১৯৪১ সালে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। তিনিই ছিলেন তখনকার বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে সামরিক ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি আত্মনিয়োগ করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গঠনে। এ সময় তিনি ল্যাফটেনেন্ট কর্ণেল পদে উন্নীত হন। ১৯৫৭ সালে উন্নীত হন কর্ণেল পদে। ইপিআর প্রতিষ্ঠায় রয়েছে তার বিশাল অবদান। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনায় গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় তার ওপর। ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে তিনি দু’বার জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। পিতার চাকরির সূত্রে তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন জায়গায়। তাই কিছুদিন পর বদলির আদেশ নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে চলে যেতে হয় গোহাটিতে। আর সেখানেই ওসমানীর প্রাথমিক শিক্ষার শুরু হয়। ১৯২৩ সালে `কটনস্ স্কুল অব আসাম`-এ ভর্তি হন তিনি। স্কুলের প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম হতেন। ১৯৩৪ সালে সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে। সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ব্রিটিশ সরকার এম এ জি ওসমানীকে প্রাইওটোরিয়া পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৩৮ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতক শেষ করেই যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৭০ সালে। এ বছর তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে `৭০-এর নির্বাচনে ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ-বিশ্বনাথ এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওসমানী সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ভাষণ দেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার, ওসমানীকে করা হয় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। ওসমানী`র নির্দেশনা অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের ‘সেক্টর কমান্ডার’ হিসেবে এক একজন সেনাবাহিনীর অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে সমন্বয়সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা- প্রভৃতি কাজ সাফল্যের সাথে পালন করেন ওসমানী। বিচক্ষণতার সঙ্গে সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল দক্ষ এবং সংখ্যায় অনেক বেশি। এই বিবেচনায় ওসমানীর রণকৌশল ছিল প্রথমে শত্রুকে নিজেদের ছাউনিতে আটকে রাখা এবং তাদেরকে যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যম হতে বিছিন্ন করে রাখা। এজন্য ওসমানী মে মাস পর্যন্ত নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মে মাসের পর তার মনে হয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক সৈন্য নিয়ে শত্রুকে ছাউনিতে আটকে রাখা গেলেও ধবংস করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি তিনি সরকারকে জানিয়ে যুদ্ধে কৌশলগত পরিবর্তন আনেন। প্রাক্তন ইপিআর এর বাঙালি সদস্য, আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে একটি গণবাহিনী বা গেরিলাবাহিনী গঠন করেন। মুক্তির সংগ্রামে ওসমানীর হাতে কোনো নৌবাহিনী ছিল না। তিনি একটি নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে তারা নদীপথে শত্রুর চলাচল প্রায় রুদ্ধ করে দেন। নৌবাহিনী গঠনের ফলে একটা বড় ধরনের সংকটের অবসান হলেও দেশ স্বাধীন হবার আগে আগে আরও একটা সঙ্কট অনুভব করেন ওসমানী। সেটা হচ্ছে তার হাতে কোনো বিমানবাহিনী ছিল না। শেষের দিকে ছোট্ট একটি বিমানবাহিনীও গঠন করেছিলেন তিনি। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় বাংলা কবিতা ‘চল চল চল’ কে পাকিস্তান ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মার্চ সঙ্গীত হিসাবে অনুমোদন লাভে সফল হন। এ ছাড়া পাকিস্তান সামরিক বাদ্যযন্ত্রে সরকারি ভাবে ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ ও ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ’ বাংলা গান প্রচলন হয় তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। বেঙ্গল রেজিমেন্ট তার নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল। এজন্যে তাকে Father of the regiment বলা হয়। তিনি বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আচরণ ও ব্যবহারে ক্ষুব্ধ ছিলেন। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করার পর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মন্ত্রীসহ উচ্চ পদের লোভ পেয়েও গ্রহণ করেননি তিনি। যুদ্ধপরবর্তী জীবনে ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাকে বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সের জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে দায়িত্ব থেকে অবসর নেন। মন্ত্রীসভায় যোগ দেন অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে। ১৯৭৩ সালের মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ওসমানী তার নিজের এলাকা থেকে অংশ নেন এবং নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। ১৯৭৩ এর নির্বাচনে ওসমানী ৯৪ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন। ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ, জাহাজ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৪ সালের ২৯ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ পান, তবে ৩ নভেম্বর জেলহত্যার ঘটনার পর পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ওসমানী `জাতীয় জনতা পার্টি` নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার্থে লন্ডন থাকাকালীন ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিলেটে সমাহিত হন। তার অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী শাহজালাল (রঃ) এর দরগাহ সংলগ্ন কবরস্থানে মায়ের পাশে লাশ সমাহিত করা হয়। বঙ্গবীর ওসমানীর স্মরণে ঢাকায় গড়ে উঠেছে ‘ওসমানী উদ্যান’ ও স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ‘ওসমানী মেমোরিয়াল হল’। এ ছাড়া তার সিলেটস্থ বাসভবনকে পরিণত করা হয়েছে জাদুঘরে। সরকারি উদ্যোগে সিলেট শহরে তার নামে একটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ সেপ্টেম্বর ২০১৮/টিপু