সাতসতেরো

ভাগ্য বিড়ম্বিত জিনিয়া

খালেদ সাইফুল্লাহ : সময়টা মধ্যরাত। গুটিকয়েক জনমানুষ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি, ভিসি চত্বর, বটতলা সব জায়গা থেকেই ঘরে ফিরতে শুরু করেছে সবাই। শহরটা ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘরে মুখ লুকাতে শুরু করেছে। এমন সময়েও এইসব জায়গাতে দেখা যায় কিছু কচি মুখের আনাগোনা। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় শুকনা মুখে নিশাচরের মতো তখনো তারা ব্যস্ত অন্যের সামনে হাত পাততে। মন চাইলে কেউ ২ টাকা ধরিয়ে দেয়, আবার অনেকেই কাছে ঘেষতে দেয় না। তবে যে যাই বলুক এক প্রকার জোর করেই টাকা আদায় করে নিতে চায় তারা, যেন এটা তাদের অধিকার। মাঝরাতের এইসব নিশাচর শিশুদের একজন জিনিয়া। মায়ের সঙ্গে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়ক দ্বীপে। জিনিয়ার ভাষ্যমতে, তার বয়স ৮ বছর। তাকে দেখে একথা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়। সারাদিনে আধপেটা খেয়ে মাঝরাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে। হাতে সবসময়ই একটা প্লাস্টিকের কৌটা। এর ভেতরেই সে টাকা রাখে। তবে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়াও জিনিয়াকে কখনো কখনো দেখা যায় ফুল বিক্রি করতে। জিনিয়ার মতো যারা এসব কাজে জড়িত, কোনো কিছুর বিনিময়েই তাদের মুখ খোলানো ভার। তবে জিনিয়া তার ব্যতিক্রম। ধীরে ধীরে রাত গভীর হয়, সেও কথায় কথায় এগোতে থাকে। জিনিয়াদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে। এর বেশিকিছু সে আর বলতে পারে না। একসময় তার পরিবার বেশ স্বচ্ছল ছিল। বাবা ব্যবসা করত। জিনিয়ার বড় এক ভাই ও বোন এবং ছোট বোন আছে। তার বড় বোনটির সম্পর্ক ছিল একটি ছেলের সঙ্গে। এটা একমাত্র জিনিয়াই জানত বলে দাবি তার। ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানতে পেরে তার বাবা তাকে অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেয়। কিছুদিন পরেই তার বোন সেখান থেকে পালিয়ে তার প্রাক্তন প্রেমিকের হাত ধরে পাড়ি জমায় অন্য কোনো শহরে। এরপর শত চেষ্টাতেও তাকে আর ফেরানো যায়নি। এর কিছুদিন পরই তার বাবা কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ফলস্বরূপ মৃত্যুই হয় তার শেষ পরিণতি। বাবার মৃত্যুর পর সপরিবারে তারা পাড়ি জমায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। সেখানে ভাড়া বাড়িতে বসত করতে থাকে তারা। কিছুদিন পরই জিনিয়ার বড় ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়। চিকিৎসার খরচ বহন করতে গিয়ে ঋণের দায় মাথায় নিতে হয় জিনিয়ার মাকে। বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে নাকাল হওয়া পরিবারটাকে আরো একজনের চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে অকূল-পাথারে পড়া ছাড়া কোনো উপায় আর থাকে না। সবশেষে ঋণের দায় শোধ করতে তাদেরকে পাড়ি জমাতে হয় ইট পাথরের শহর ঢাকাতে। ভিক্ষাবৃত্তিই হয়ে ওঠে জিনিয়ার শেষ পরিণতি। জিনিয়ার মা পানির বোতল কুড়িয়ে তা বিক্রি করে। তার ছোট বোন চকলেট বিক্রি করে। সকাল হতে না হতে মানুষের আনাগোনা বাড়ার আগেই শুরু হয় তাদের প্রাত্যহিক সংগ্রাম। দিনশেষে যেভাবেই হোক তার মায়ের হাতে ২০০ টাকা তাকে তুলে দিতে হয় তাকে। অন্যথায় তার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। জিনিয়ার বর্ণনায়, তার মা নিজেই তাকে মারধর করে। একইভাবে তার বোনের ওপরও চলে নির্যাতন। তার বোনের লিমিট ১০০ টাকা। জিনিয়াদের সঙ্গেই থাকে তার নানী ও খালা। খালার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সে নিজের ভাইবোনের হিসাবটা গুলিয়ে ফেলে। তবে তার মতোই একইভাবে নির্যাতন তাদের শরীরেও। মাঝে মাঝে ট্রাফিক পুলিশের ভর্ৎসনায় নিবৃত্ত হয় তাদের মায়েরা। জিনিয়ার শরীরে এমন অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। সারাদিনে মায়ের মর্জি ছাড়া একমুঠো খাবারও তার মুখে দেওয়া নিষেধ। তাই কেউ কিছু খেতে দিলেও সেটা খাওয়া হয় না তার। সবকিছুর মাঝেও তার চিন্তা একটাই- কিভাবে দিনশেষে মায়ের হাতে ২০০ টাকা ধরিয়ে দেওয়া যাবে। জিনিয়ার ভাষ্যমতে, টাকা দিয়ে তার মা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে। প্রতিনিয়ত ঋণের কিস্তি শোধ করতে গিয়ে এসব কিছু করতে বাধ্য হয় তার মা। তবে দুই মাস ঢাকায় থাকার পর তারা আবার ভৈরবের ভাড়ার বাড়িতে গিয়ে থাকে। সেখানে অন্য সবার মতো জিনিয়াও তার ছোট বোনের সঙ্গে খেলা করে, অন্যদের মতো দিন কাটে তাদের। কিন্তু বাকি দিনগুলোতে আবার শুরু হয় তাদের সংগ্রাম। দিন যায়, ঢাকা শহরে নতুন নতুন অট্টালিকা তৈরি হয়, ভবনগুলোর উচ্চতা দ্বিগুণ হয়, কিন্তু জিনিয়াদের ভাগ্য আর পরিবর্তন হয় না। গাছতলা থেকে তাদের আর ছাদের নিচে রাত কাটানোর সৌভাগ্য হয়ে ওঠে না। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ অক্টোবর ২০১৮/ফিরোজ