সাতসতেরো

লন্ডনে বরিশালের ঝালমুড়ি

মহিউদ্দিন অপু : ‘হ্যালো, ব্রাদার-সিস্টার। প্লিজ কাম হিয়ার। প্লিজ টেস্ট মাই স্পেশাল স্পাইসি ঝালমুড়ি। প্লিজ...’ বলেই প্রথমে একমুঠ মুড়ি তুলে নিলেন। তাতে মেশালেন বাদাম ভাজা, মেশালেন ছোলা। সঙ্গে দিলেন পিঁয়াজ, শশা, মরিচ, ধনেপাতা, আদা কুচি। এরপর চিপে দিলেন কয়েক ফোটা লেবুর রস। সঙ্গে সামান্য সর্ষের তেল ও বিট লবণ মিশিয়ে আচ্ছামতো নাড়লেন বেশ কিছুক্ষণ। এরপর খবরের কাগজ কিংবা ঠোঙায় না দিয়ে প্লাস্টিকের গ্লাসে করে গ্রাহকের হাতে হাতে পরিবেশন করতে লাগলেন। ঘটনাটি কোনো লোকাল বাস, ট্রেন কিংবা বাংলাদেশের কোনো স্কুল, কলেজ বা রাস্তার পাশে নয়। ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে এভাবেই বিক্রি হচ্ছে ঝালমুড়ি। লন্ডনে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে কাউকে কথা বলতে শোনা স্বাভাবিক। তাই বলে ‘ঝালমুড়ি’ শব্দটি হঠাৎ করেই কানে বাজে। ঝালমুড়ির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ ও ভারত হলেও এটি এখন সর্বত্র জনপ্রিয় একটি খাবার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু ‘ঝালমুড়ি’ ইংরেজি শব্দ নয়। স্বভাবতই শব্দটা শুনে ঘাড় সেদিকে ঘুরে গেল। ওমা! এ দেখি পুরো দেশি কায়দায় বিলেতি ঝালমুড়ি। যিনি ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন তিনি একজন বাঙালি। কথাগুলো বলছিলেন এ বছর বাংলাদেশ থেকে কমনওয়েলথ যুব ফোরামে (সিওয়াইএফ) অংশগ্রহণকারী সোহানুর রহমান সোহান। সোহানুর রহমান জানান, পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলে সবজি বাজারের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি বিক্রেতার বাড়ি বাংলাদেশে। নাম আবদুর রহিম। ৬০ বছরের কাছাকাছি বয়সী আবদুর রহিমের জন্ম বরিশালে। প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ করে ২০ বছর পূর্বে দালালের মাধ্যমে প্রথমে দুবাইয়ে পা রাখেন তিনি। মাস দুয়েক সেখানে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও প্রচণ্ড গরমে মাটির নিচের একটি ঘরে ২০-২২ জনের একসঙ্গে থাকাটা খুব কষ্টের হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। ফলে আরেক দালালের হাত ধরে সমুদ্রপথে ব্রাজিল পাড়ি জমান। এভাবে মোট চারটি দেশ ঘুরে অবশেষে  লন্ডনে আসেন তিনি। তত দিনে কেটে যায় প্রায় পাঁচ বছর। স্বল্প শিক্ষা, ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতা, শারীরিক অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে কোথাও যখন নিজের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি তখন ঝালমুড়ি বিক্রির চিন্তা তার মাথায় আসে।  ঝালমুড়ি তিনি আগে থেকেই ভালো বানাতেন। সারা দিন কাজ শেষে বাসায় ফেরার পর মরিচ, পেঁয়াজ মাখিয়ে মুড়ি বানালে সহকর্মীরা প্রশংসা করতেন। সঙ্গীদের কেউ ফিলিপাইনের, কেউ মরক্কোর, কেউ আফ্রিকার বাসিন্দা। তাদের কাছ থেকে ও নিজের সব মিলিয়ে মোট ৩৫ পাউন্ড জোগাড় করে তিনচাকার ঠেলাগাড়িতে শুরু হয় আবদুর রহিমের ভাসমান ঝালমুড়ির ব্যবসা। প্রথম প্রথম বিক্রেতা কম হলেও তার ঝালমুড়ির এখন বেশ চাহিদা। ভালোই আছেন এখন। ছয় মাস পরপর বাংলাদেশে টাকা পাঠান। বছর দশেক আগে দেশে ফিরে বিয়ে করেন। একটি ছেলে আছে। বর্তমানে তার পরিবার বরিশাল শহরে বাস করছেন।  সোহান আরো জানান, হোয়াইট চ্যাপেলের রাস্তার পাশে ফুটপাতের ওপর অসংখ্য ফল, সবজি, মাছ আর জামাকাপড়ের দোকান। দোকানগুলোর বেশিরভাগই পরিচালনা করছেন এশীয়রা। বিশেষ করে বাঙালি, ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা। হোয়াইট চ্যাপেলকে ‘সিলেটিপাড়া’ উল্লেখ করে আবদুর রহিমের বরাত দিয়ে সোহান আরো জানান, এখানে ভারতীয় আর পাকিস্তানিরাই বেশি ঝালমুড়ি কেনেন। সন্ধ্যার পরে টেমসের পাড়ে পাবগুলোর দিকে চলে যান আবদুর রহিম। সেখানেও ভালো বেচাকেনা হয়। তার মতে, সেখানে সিলেটিই বেশি। তিনি 'ককি' ভালো জানেন বলে ঝালমুড়ি বিক্রি ভালো হয়। সেখানকার স্ট্রিট ল্যাংগুয়েজ অর্থাৎ রাস্তার ভাষাকে ‘ককি’ বলা হয়। লন্ডনে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গরা এ ভাষায় বেশি কথা বলেন এবং বর্তমান প্রজন্মের বাঙালি তরুণ-তরুণীরাও বেশ ভালোভাবেই ভাষাটি রপ্ত করে নিয়েছেন। কারণ এটি শুধু বাচনভঙ্গির ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা ধরনের অঙ্গভঙ্গি এবং পোশাকও জড়িত। ইংরেজরাও এই ভাষা ভালো বোঝেন। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ নভেম্বর ২০১৮/তারা