সাতসতেরো

‘স্বাধীনতার খবর পাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে’

সাইফুল ইসলাম: জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির বর্তমান সভাপতি আব্দুল হাই তালুকদার (৭০)। ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন সিরাজগঞ্জ কলেজে। তখন থেকেই যুক্ত হয়ে পড়েন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। সিরাজগঞ্জ সদর থানা চিলগাছা গ্রামের মফিজউদ্দিন তালুকদারের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আব্দুল হাইয়ের মনে দেশ স্বাধীন করার আকাঙ্খা গড়ে ওঠে সেখান থেকেই। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ আরো স্পষ্ট হয় সেই লক্ষ্য। সিরাজগঞ্জের তৎকালীন এসডিও শামসুদ্দিন স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষ নেন। ফলে সেখানে একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। কিন্তু ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার অবাঙালি দোসর দখল করে নেয় সিরাজগঞ্জ শহর। ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা। আব্দুল হাই তালুকদার শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান। এ সময় তিনি এবং স্থানীয় ছাত্রনেতা ইয়াকুব আলীসহ আরো কয়েকজন অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই সংঘটিত হন। অন্যদিকে, পাকিস্তানীদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরাও। একদিন তাদের এলাকার কুড়াগাছা হাটখোলার পাশ দিয়ে চাইনিজ রাইফেল কাঁধে নিয়ে যাচ্ছিলেন দুই ইপিআর সদস্য। তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র বহন করতে ভয় পাচ্ছিলেন। আব্দুল হাই ও ইয়াকুব তাদের সঙ্গে কথা বলেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন তারা অস্ত্র বহন করার বিষয়টি অকপটে বলেন। এ সময় নিজেদের পরিচয় দিয়ে অস্ত্র দুটি রেখে দেন তারা। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ালো, আব্দুল হাই ও ইয়াকুব চাইনিজ অস্ত্র চালাতে জানেন না। এ পরিস্থিতিতে তারা চলে যান পার্শ্ববর্তী বাহুকা গ্রামে ছাত্রলীগের এক সিনিয়র নেতার কাছে। তিনি আব্দুল হাইদের দুটি চাইনিজ রাইফেল রেখে একটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল দেন। কারণ এটাই তখন তারা চালাতে জানতেন। এদিকে, শান্তি কমিটি গঠন করে এলাকায় তৎপর হয়ে ওঠে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। ফলে মুক্তিকামী সশস্ত্র মানুষের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে এলাকায়। স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের সহায়তায় গণহত্যা চালানো হয় বাগবাটীতে। এ সময় তারা খবর পান যে, পলাশডাঙ্গা যুব শিবির গঠন করা হয়েছে। সেখানে অবস্থান করছেন তৎকালীন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা আব্দুল লতিফ মির্জা। খবর পেয়ে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে দুজন যোগদান করেন পলাশডাঙ্গায়। সেখানে আব্দুল হাই তালুকদারকে সুনির্দিষ্ট দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। তার একটি হচ্ছে হিসাব-নিকাশ সামাল দেওয়া। এর পাশাপাশি কখনো আক্রমণ কখনো আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ। সর্বশেষ পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযোদ্ধারা ১১ নভেম্বর আক্রান্ত হন তাড়াশের হান্ডিয়াল-নওগাঁয়। প্রকৃতি ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এক কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্য এবং তিন শতাধিক রাজাকারকে পরাজিত করে তারা সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হন। এ যুদ্ধে তারা বিপুল সংখ্যক ভারি ও হালকা অস্ত্র হস্তগত করতে পারলেও দেখা দেয় গোলা-বারুদের অভাব। পলাশডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধারা তখন মুক্ত এলাকা রৌমারীতে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেন। আরো সিদ্ধান্ত নেন যে, গোলাবারুদ সংগ্রহ হলেই তারা ফিরে আসবেন এলাকায়। নানা বিপত্তি পেরিয়ে অক্ষত অবস্থায় তারা রৌমারী পৌঁছেন নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে। বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে গোলাবারুদও সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ততদিনে মুক্তিযুদ্ধ শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। বিএলএফ থেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না দিয়ে জানানো হয়, আরো কিছুদিন দেরী করে দেশের অভ্যন্তরে ঢোকার জন্য। ফলে রৌমারীতেই আটকা পড়ে যায় পলাশডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধারা। রৌমারীতে বসেই আব্দুল হাই তালুকদার জানতে পারেন ভুটান, নেপাল, ভারতের স্বীকৃতির খবর। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী নিয়ে গঠিত হয় যৌথবাহিনী, শুরু বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার চূড়ান্ত অভিযান। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর তারা পান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। আত্মসমর্পণের খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উল্লাসে ফেটে পড়ে সবাই। আর তখনই সিদ্ধান্ত নেন এলাকায় ফিরে আসার। পরের দিন নৌকায় উল্লাস করতে করতে রওনা হন নিজেদের এলাকায়। আব্দুল হাই তালুকদার জানান, সে বিজয়ের দিনে আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরে আসার অনুভূতি সত্যি অন্যরকম। কীভাবে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে জনগণের বাসযোগ্য করা যায়, সে স্বপ্নে আমরা বিভোর। আব্দুল হাই তালুকদার আরো জানান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হয়নি, ফলে জনগণের দেখা স্বাধীনতার স্বপ্নও বাস্তবায়ন হয়নি। হলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে আত্মাহুতি দিতে হতো না। তিনি জানান, এখনকার বিজয় দিবসে জনগণের মধ্যে সেদিনের উল্লাস অনুপস্থিত। তবে তিনি আশাবাদী, দ্রুতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হবে, জনগণও অংশ নেবে সে বিজয় উল্লাসে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা