সাতসতেরো

‘তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক’ সম্মাননা পেলেন চার তরুণ গবেষক

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : মহান বিজয়ের মাসে ‘তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সম্মাননা-২০১৮’ পেলেন দেশের তরুণ চার ‘মুক্তিযুদ্ধ গবেষক’। বিজয়ের মাসকে স্মরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ প্রথমবারের মতো এই সম্মাননা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ১৫ ডিসেম্বর, শনিবার টিএসসির পায়রা চত্বরে টিএসসিভিত্তিক সকল সংগঠনের অংশগ্রহণে আয়োজিত ‘রক্তে রাঙা বিজয় আমার’ বিজয় উৎসবের মঞ্চ থেকে এই সম্মাননা প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। প্রথমবারের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সম্মাননা পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের ভূমিকা (জন ইতিহাস) গবেষণায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. চৌধুরী শহীদ কাদের, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় আন্তর্জাতিক পযায়ে অবদানের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুস সামাদ, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় গণমাধ্যমে অবদানের জন্য প্রথম আলোর ছুটির দিনের এডিটর ইনচার্জ সজীব মিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় অবদানের জন্য সম্মাননা পেয়েছেন লেখক, গবেষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ রহমান। সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গবেষণা সংসদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় এমন উদ্যোগ তরুণদের মুক্তিযুদ্ধ চর্চার ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করবে।’ তিনি এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। দেশের চারজন বিশিষ্ট তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষককে ‘তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সম্মাননা-২০১৮’ প্রদান করতে পেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ গর্ববোধ করছে বলে জানান সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সাইফুল্লাহ সাদেক। তিনি জানান, ‘গত বছর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ এই উদ্যোগটি গ্রহণের পরিকল্পনা করেছে। অবশেষে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পেরেছে সংগঠনটি। আগামীতে এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। এই উদ্যোগের ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তরুণদের গভীর জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র বিস্তৃত হবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম গবেষণা সংগঠন। এই সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে অবদান রাখছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত এই সংগঠনটি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষক ও গবেষণা সংগঠনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে, তাদের মূল লক্ষ্য হলো স্নাতক পযায়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণার দিকে ধাবিত করা। তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সম্মাননা-২০১৮ প্রাপ্তদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়: * ড. চৌধুরী শহীদ কাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাধারণ মানুষের ভূমিকা নিয়ে করেছেন পিএইচডি। গবেষণা করছেন মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে। গণহত্যা নিয়ে তার সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার বহুমুখী ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা: শরণার্থী, সংবাদপত্র ও সাধারণ মানুষ’, আসামের বরাক উপত্যাকার কবিয়ালদের নিয়ে লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধে বরাক উপত্যাকার কবিতা ও কবিগান’। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ব্রাক্ষ্ম স্কুল থেকে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ গ্রন্থটি। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সিরিজ। এছাড়া দেশি- বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ। তরুণ প্রজন্মকে একাত্তরের গণহত্যা সর্ম্পকে সজাগ করতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেছেন গণহত্যা জাদুঘর। তিনি এটার ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনীর যুগ্ম-সম্পাদক। গবেষক হিসেবে সম্পৃক্ত আছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নির্মিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানের অন্যতম পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। গণহত্যা নিয়ে নির্মাণ করছেন টিভি সিরিজ। নিয়মিত লিখছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। নানাবিধ প্ল্যাটফর্মে কাজ করে একাত্তরের গণহত্যা জনমানসে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে পেয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার। * ড. আব্দুস সামাদ দিল্লি ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগ থেকে ‘ইকোলজি অ্যান্ড ন্যাশনালিজম বাংলাদেশ’ বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে ১০টি এবং জাতীয় পর্যায়ে ৮টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ‘বিষয় ভিত্তিক’ বক্তা হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন। লেখালেখিও চালিয়ে নিচ্ছেন সমানতালে। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে ৪টি বই। এর মধ্যে রয়েছে- * ‘হিস্ট্রি অব বাংলাদেশ, ১৯০৫-২০০৫ (ঢাকা ইউনিভার্সিটি পাবলিকেশন্স) * হিস্ট্রি অব লিবারেশন ওয়ার অব বাংলাদেশ (ঢাকা ইউনিভার্সিটি পাবলিকেশন্স) * বার্থ অব বাংলাদেশ, এন ইকোলজিক্যাল পারসপেক্টিভ (জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি প্রেস) * ইকোলজি অ্যান্ড ন্যাশনালিজম ইন সাউথ এশিয়া (নিউ দিল্লি) ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থেকেছেন বিতর্ক, বক্তৃতা আর লেখালেখির মতো সৃজনশীল সকল কাজে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশপাশি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগেও অতিথি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষকতা শুরুর আগে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১ বছর। এরপর তিনি বিসিএস চাকরি ছেড়ে দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি তরুণদের গবেষণা উন্নয়নে অবদান রাখছেন। সজীব মিয়া জন্ম জামালপুর জেলায়। কাজ করেছেন এশিয়াটিক সোসাইটির ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের তথ্যকোষ’ শিরোনামে একটি প্রকল্পের আঞ্চলিক গবেষক হিসেবে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ছুটির দিনে’র এডিটর ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পেশাগত দায়িত্ববোধের সঙ্গে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার সম্মিলনের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে এই তরুণ সাংবাদিকের প্রতিটি কাজে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পাগলা ঘণ্টা বাজানো সেই পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল আলী, ক্র্যাক প্লাটুনের হারিয়ে যাওয়া গেরিলা যোদ্ধা সৈয়দ হাফিজুর রহমান কিংবা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে দেশত্যাগী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান; এমন অন্তরালে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গণমাধ্যমে তুলে এনে পৌঁছে দিয়েছেন বর্তমান প্রজন্মের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত অনুসন্ধানী গবেষণায় নিরন্তর মেধা-শ্রম আর সময় দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আরিফ রহমান কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়কে জানার জন্য কিংবা ওই সময়কার ঘটনাপ্রবাহকে ব্যাখ্যা করার জন্য সমসাময়িক না হয়েও যে শুধুমাত্র তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ ও বহুমুখী পর্যালোচনার মাধ্যমে চমৎকার ভাবে তা উপলব্ধি ও বর্ণনা করা সম্ভব, তার দৃষ্টান্ত তরুণ বিশ্লেষক আরিফ রহমান। মুক্তমনা ব্লগ থেকে লেখালেখির শুরু করে তিনি এখন নিয়মিত লেখালেখি করে চলছেন বিডিনিউজ২৪, প্রথম আলো সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশক’টি পত্র-পত্রিকায়। তার লেখা প্রথম গ্রন্থ ‘ত্রিশ লক্ষ শহীদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা’ সারাদেশে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তার সম্পাদিত গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধ: কিছু বিভ্রান্তির জবাব’। এছাড়া তিনি যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর রায়ের বাংলা অনুবাদক দলের সঙ্গে কাজ করেছেন। গণহত্যা অস্বীকার বিরোধী আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটি ই-বই সম্পাদনা করেছেন। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সভা-সেমিনারে কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, অংশগ্রহণ করেছেন প্রচুর টেলিভিশন আলোচনায়। তার কাজের ওপর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন একটি ডকুমেন্টারিও প্রকাশ করে। এছাড়া তিনি গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন একাত্তরের বধ্যভূমির ডিজিটাল ম্যাপিং-এর প্রকল্প ‘মুক্তিপিন’-এর সঙ্গে। বর্তমানে তিনি অনলাইন পত্রিকা ‘বাঙালীয়ানা’র যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ