সাতসতেরো

অটিজম ও বাংলাদেশ

মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান : আজ ২ এপ্রিল ১২তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ২০১৯ । দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার’ যা অত্যন্ত সময়োপযোগী। বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন সুদৃঢ় অবস্থানে দাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে যাবার পাশাপাশি প্রায় প্রতিঘরেই ইন্টারনেট সেবা পৌছে গেছে। অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মত করে দেশের অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদেরও ডিজিটাল সেবার প্রয়োজন রয়েছে । প্রতিবছর সারাবিশ্বে ২রা এপ্রিল অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও প্রতিবছর এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, সামাজিক সংগঠনসমূহ বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামুলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ এই পথে কতটা এগিয়েছে, তা অভাবনীয়। ১৪টি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স। আটটি মন্ত্রণালয়/বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি। এর মধ্যে প্রথম সারির পাঁচটি হলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বেসরকারী পর্যায়েও অনেক বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী হয়েছে। অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন কখনও সরাসরি, কখনও ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে সকল জাতীয় কর্মকান্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অটিজম কি?

অটিজম কোন রোগ নয় এটি শিশুদের মস্তিষ্কের সাভাবিক বিকাশজনিত একটি সমস্যা, যা শিশুর সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা সৃষ্টি করে। অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুর চেহারা হয় খুবই সুন্দর, কিন্তু সে তার মা বাবা বা আপনজনের ডাকে সাড়া না দিয়ে নিরব থাকে। শিশুর এ নিরবতাই জন্মদায়িনী মায়ের মনোবেদনার কারণ হয়ে চোখের অশ্রু ঝরায়। এ ধরনের শিশুকে নিয়ে মা নিদারুন অবহেলায় অবশিষ্ট জীবন কাটিয়ে দেন। এ ধরনের শিশুর জন্মের জন্য পিতা মাতাকে দায়ী করা যায় না। কি কারণে অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশুর জন্ম হয় বিজ্ঞানীরা তা নির্ণয় করতে আজও সক্ষম হয়নি। অটিস্টিক সন্তানদের পিতা-মাতা/অভিভাবক ও কেয়ার গিভারদের প্রশিক্ষণ :

অটিজম বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০০৯ সন হতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণে অটিস্টিক জনগোষ্ঠির পাশাপাশি তাদের পিতামাতা ও অভিভাবককেও সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। এ যাবৎ অনুষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে অটিস্টিক শিশুর ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণে ১৫টি ব্যাচে ৪৭২ জন পিতা-মাতাকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে যা উল্লেখযোগ্য। এ সকল প্রশিক্ষণ পরিচালনায় অটিজম বিষয়ে দক্ষ সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, চিকিৎসক, এনজিও প্রধানসহ ভিন্ন ভিন্ন পেশায় দক্ষ প্রশিক্ষকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। স্নায়ুবিকাশের ভিন্নতাজনিত সীমাবদ্ধ পরিস্থিতিতে মানুষ যথাযথভাবে সামাজিক যোগাযোগ সংরক্ষণ, চলাফেরা, ভাববিনিময় এবং দৈনন্দিন কার্যনির্বাহে পরিপূর্ণ অংশগ্রহণে সমর্থ হয়না। স্নায়ুবিকাশের ভিন্নতার প্রধান ধরণগুলোহলো অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা ও সেরিব্রাল পালসি। অটিজম সংক্রান্ত চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র :

ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (IPNA) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা; জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট; চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক, শেরে বাংলা নগর, ঢাকা; ঢাকা শিশু হাসপাতাল; শিশু বিকাশ কেন্দ্র; সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ঢাকা; প্রয়াস বিশেষায়িত স্কুল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট; মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এর শিশুরোগ/মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, নিকটস্থ জেলা সদর হাসপাতাল/ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স; সরকার অনুমোদিত বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা ও বিশেষায়িত স্কুল; প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন হতে এ সংক্রান্ত সহায়তা পাওয়া যাবে। মিনারেল /ড্রিংকিং ওয়াটার প্লান্ট :

প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় টঙ্গীস্থ ইআরসিপিএইচ কেন্দ্রে একটি মিনারেল/ড্রিংকিং ওয়াটার প্লান্ট স্থাপন করা হয়েছে। অত্যাধুনিক মেশিন রিভার্স ওসমোসিস পদ্ধতিতে দৈনিক ৫০০ লিটার উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন এ প্লান্টের মাধ্যমে বোতলজাতকৃত পানি মুক্তা মিনারেল /ড্রিংকিং ওয়াটার নামে বাজারজাত করা হচ্ছে। এ প্লান্টের আয় শুধুমাত্র প্রতিবন্ধীদের কল্যাণার্থে ব্যয় করা হয়। ব্রেইল প্রেস:

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের জন্য টঙ্গীস্থ ইআরসিপিএইচ কেন্দ্রে স্থাপিত ব্রেইল প্রেসের মাধ্যমে মুদ্রিত পুস্তক বিনামূল্যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে সরবরাহ করা হয়। কৃত্রিম উৎপাদন কেন্দ্র : টঙ্গীস্থ ইআরসিপিএইচ কেন্দ্রে স্থাপিত এ কেন্দ্রটি উৎপাদন কৃত্রিম অঙ্গ শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে বিনামূল্যে/হ্রাসকৃত মূল্যে সরবরাহ করা হয়। প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদন কেন্দ্র : টঙ্গীস্থ ইআরসিপিএইচ কেন্দ্রে প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্টের আওতায় স্থাপিত মৈত্রী শিল্প কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্লাস্টিক সামগ্রী যেমন: বালতি, জগ, মগ, বদনা, গ্লাস, হ্যাঙ্গার উৎপাদন করা হয়। অটিজম রিসোর্স সেন্টার : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ঢাকাস্থ মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের নিজস্ব ক্যাম্পাসে ২০১০ সালে যাত্রা শুরু হয় অটিজম রিসোর্স সেন্টারের। ২০১০ সালের ২ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত সেন্টারের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। একটি সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিমের সমন্বয়ে অটিজম রিসোর্স সেন্টারটি পরিচালিত হচ্ছে। নীলবাতি প্রজ্বলন : বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস উপলক্ষ্যে ও দেশে অটিজম দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরতে দেশের সকল সরকারি, বে-সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে তিনদিন ব্যাপি নীলবাতি প্রজ্বলন করা হয়। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর/ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা রাষ্ট্রীয় পর্যায় হতে নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের আইনি সুরক্ষা : (ক) অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা ও সেরিব্রাল পালসি আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষায় ২০১৩ সনে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ প্রণয়ন; (খ) প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩ প্রণয়ন; (গ) এ বছর ১০ম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনের শেষ আইন বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন-২০১৮” পাস করা হয়েছে। এই আইনটির ফলে দেশের বিদ্যমান প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কিংবা দূর্ঘটনার ফলে পঙ্গুত্ববরণকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া  গ্রহণ করা হবে। সরকার  সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি যেমন, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি এবং প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রসহ অন্যান্য অনেক কর্মকান্ডের মাধ্যামে প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে । এ অব্যাহত প্রচেষ্টা প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের মানসকি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ জীবন গঠনের পথকে আরো প্রসারিত করবে। সরকারের পাশাপাশি সূচনা ফাউন্ডেশন, প্রয়াস, সোয়াক, সিডিডি, পিএফডিএ, স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন (এসজিসি), সোসাইটি ফর দ্যা ওয়েলফেয়ার অব দ্যা ইন্টেলেকচুয়ালি ডিজএ্যাবলড (সুইড) বাংলাদেশ, সীড ট্রাস্ট, অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, বিউটিফুল মাইন্ড, নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন, এফএআরইসহ আরও অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদার, সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি, অটিজম ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজএ্যাবিলিটিস বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের বিকাশে আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি- বেসরকারি উদ্যোগে আন্তরিকভাবে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির কল্যাণে অংশগ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভিলক্ষ্যের ভিত্তিতে সকলের জন্য সমঅধিকার, ন্যায়পরায়নতা ও সুন্দর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ অচিরেই উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার গৌরব অর্জনে সক্ষম হবে। অটিজম শিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ তাদের অধিকার ও উন্নয়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তারা সমাজের বোঝা নয় বরং সঠিক পরিচর্যা পেলে তারাও সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। লেখক : তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকমর্তা

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ এপ্রিল ২০১৯/আসাদ/এনএ