সাতসতেরো

ঘর নদীতে, তবুও ভিটে ছাড়েননি আলতাফ

জুনাইদ আল হাবিব : প্রতিদিন কেউ না কেউ ঘর-বাড়ি হারাচ্ছেন। বাপ-দাদার ফসলি জমি চোখের সামনেই নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই মেঘনাপাড়ের মানুষের। শুধু চোখ থেকে পানি ফেলে দুঃখকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন তারা। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন বসত-ভিটা সরিয়ে অন্যত্র ঠিকানা বদলের। অনেকে চলেও গেছেন নিরাপদ দূরত্বে।

এখানেই ব্যতিক্রম আলতাফ হোসেন। আলতাফের ঘরের অর্ধেক ভিটে নদী  গিলে খেয়েছে। তবুও আলতাফ ভিটে ছাড়েননি। বেদনায় চোখ ভিজে ওঠে, বিষণ্ন হয় মেঘনাপাড়ের বাতাস। আকাশ তবু নীল ছড়ায়। কিন্তু সেই নীল আলতাফের দুঃখের চেয়ে গাঢ় নয়। মেঘনার ভাঙনে তিনি যে এখন অসহায়। কোথায় মাথা গুঁজবেন জানেন না। অথচ আলতাফের পরিবার ছিল এলাকায় প্রভাবশালী। বিশাল জমির ওপর বাড়ি করেছিলেন। মেঘনা নদীর গহ্বরে সেই বাড়ির অর্ধেক ইতিমধ্যেই চলে গেছে। সেই সঙ্গে মুছে যেতে বসেছে বাড়ি নিয়ে আলতাফের স্বপ্ন।

লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের চর কালকিনি ইউনিয়নের মৃত নুর মোহাম্মদ মেম্বারের ছেলে আলতাফ। উপজেলার পশ্চিম চর লরেন্স হাজিগঞ্জ বাজারের সামান্য পশ্চিমে আলতাফের বাড়ি। সব সময় আলতাফের আড্ডা জমতো হাজিগঞ্জ বাজারে। সেটি ছিল বিশাল বাজার। ছিল বড় মসজিদ। এমনকি পাঁচ দিনব্যাপী বিশাল আয়োজনের মাহফিলও হতো এখানে। কিন্তু সে বাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে দু’বছর আগে।

 

বাজার ভেঙে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে ওখানকার বহু স্থাপনা নদীর বুকে চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে নদী চলে আসে আলতাফের ভিটের কাছে। এখন আলতাফ ভিটেমাটি থেকে ঘর সরিয়েছেন। ঘরে থাকা অন্যান্য আসবাবপত্রও সরিয়ে বাড়ির আরেকটি ঘরে রেখেছেন। কিন্তু কোথায় ঠাঁই নেবেন আলতাফ? তিনি চরম দুশ্চিন্তায় প্রহর গুণছেন। মেঘনাপাড়ে গেলে ভিটের সামনেই বসে থাকতে দেখা যায় আলতাফকে। এ যেন তার এক ধরনের অনশন। জোয়ারে যে তার ভিটে বিলীন হয়ে যাবে, তা তিনি মানতে চান না।

কথা হয় তার সঙ্গে। জমি-জমা কিনেছেন? এমন প্রশ্নে আলতাফের সোজা উত্তর, ‘কি দিয়া জায়গা-জমি কিনমু? কি আছে আমাগো? সবতো গাঙ্গেই নিয়া যাইতাছে। কোথাও যে এক টুকরো জমি কিনে ঘরটা তুলমু, সে সাধ্য আমার নাই। আমি এখন কী করি!’ আলতাফের মতোই এখানকার মেঘনাপাড়ের মানুষ একেকজন একেকটা করুণ গল্প। নদী ভাঙনে যাদের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত। অনেকের দিনে দু’মুঠো ভাত ঠিকমতো খাবার মতো অবস্থা নেই। কেউ রাস্তার ধারে, কেউ অন্যের বাড়িতে, কেউবা খোলা আকাশের নিচে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। যারা এক সময় পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামবাসী হিসেবে একই রশিতে বাঁধা ছিলেন, তারা আজ বিচ্ছিন্ন। শুধু ভিটে-বাড়ি নয়, এখানকার বহু কবরস্থানের বদলের গল্পও আছে। কোনো কোনো মানুষের কবর দুইবারও স্থানান্তরিত হয়েছে।

দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এখানে মেঘনার ভাঙন চলছে। এক সময় যাদের ছিল গোয়াল ভরা গরু, মাঠ ভরা ফসল, পুকুর ভরা মাছ, তারা আজ অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। অথচ এরাই একসময় অন্যকে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। অব্যাহত ভাঙনের কারণে উপজেলার দুইটি ইউনিয়ন আজ বিলুপ্তির পথে। শুধুমাত্র কাগজ-কলমেই নামগুলো আছে। এ অঞ্চলের আরো বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে নদীভাঙন চলছে। কিন্তু ভাঙন রোধে বাঁধ না দেয়ায় এখানকার মানুষের জীবনে মেঘনা আগ্রাসী হয়ে দেখা দিচ্ছে। এখানকার মানুষ দ্রুত বাঁধ চান, বাঁচতে চান স্বাভাবিক জীবনে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুলাই ২০১৯/ফিরোজ/তারা