সাতসতেরো

শুভ জন্মদিন এঞ্জেলা গোমেজ

হাকিম মাহি : জন্মের পরেই বাবা তাঁর নাম রেখেছেন ‘ফুল’। সবাই আদর করে তাঁকে ‘ফুল কুমারী’ বলে ডাকতেন। সেই ফুল কুমারী একজন বাংলাদেশি সমাজসেবক, নারী উন্নয়ন এবং নারী অধিকার কর্মী এঞ্জেলা গোমেজ। তিনি ১৯৫২ সালের ১৬ জুলাই আজকের এই দিনে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার নাগরি ইউনিয়নের মাল্লা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

এঞ্জেলা গোমেজ সবসময় নিজেকে প্রচার থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করেন। তাই রাজধানী ঢাকা থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে এঞ্জেলা গোমেজ গ্রামের নারীদের বাঁচতে শিখিয়েছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেবামূলক সংস্থাটির নাম ‘বাঁচতে শেখা’। এটি যশোর জেলায় অবস্থিত। সংগঠনটি গ্রামের মহিলাদের মূলত আয় বাড়ানোর কর্মকাণ্ডে দক্ষতা বৃদ্ধি, কুটিরশিল্প, শস্য উৎপাদন, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন, মাছ চাষ, মৌমাছি পালন, সিল্ক উৎপাদন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

এই পর্যন্ত প্রায় ৪০০ গ্রামের ২০ হাজার মহিলাকে এই সংগঠনটি সাহায্য করেছে। বর্তমানে এখান থেকে সর্বমোট ১০ লাখ মানুষ সেবা নিয়ে যাচ্ছেন। এঞ্জেলা এই সেবামূলক কাজের জন্য ২০০০ সালে জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি সামাজিক উন্নয়নে নেতৃত্বদানের জন্য ১৯৯৯ সালে রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান।  

এঞ্জেলা যখন গাজীপুরের মঠবাড়ি মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১২ বছর। সেখানকার খ্রিস্টান পুরোহিত বার্কম্যান এঞ্জেলার মেধা দেখে একই স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে শিশুদেরকে পড়ানোর সুযোগ দেন। সেখানে তিনি মাসে ১০ টাকা বেতন পেতেন। আবার যখন তিনি অষ্টম শ্রেণি পাশ করেন, তখন এঞ্জেলা যশোর সেক্রেট হার্ট মিশন স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা পেশা দিয়েই তাঁর কর্মজীবন শুরু।

দিনে বাচ্চাদের পড়ানো এবং নিজের ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত এঞ্জেলা রাতে বাড়িতে ফিরে মোমবাতি জালিয়ে পড়াশোনা করতেন। যাই হোক, থেমে থাকেননি তিনি। ১৯৬৮ সালে যশোর শহরের সেবাসংঘ স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এসএসসি এবং ১৯৭২ সালে যশোর মহিলা কলেজে থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি পাশ করেন। নানা ধরনের প্রতিকূল আর অসহায় অবস্থাতেই তিনি ১৯৭৪ সালে যশোর মহিলা কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।

‘বাঁচতে শেখা’র বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে শিক্ষা প্রকল্প, মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা, মানবাধিকার উন্নয়ন প্রকল্প, মহিলাদের ভোট শিক্ষা প্রকল্প, হস্তশিল্প, কৃষি, হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশু পালন, মৌ চাষ, রেশম চাষ, মৎস চাষ প্রকল্প, ঘূর্ণায়মান ঋণ, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনী অন্যতম।

এই প্রকল্পের বিভিন্ন প্রকাশনাও রয়েছে। যেমন- ছোটদের সহজভাবে বাঁচতে শেখা কবিতা গুচ্ছ, ছোটদের সহজভাবে বাঁচতে শেখা, বড়দের কাজ করে বাঁচতে শেখা, ছোট্ট মনি, নারী জাগরণের গান কবিতা ও শ্লোগান, সচেতনভাবে বাঁচতে শেখা ইত্যাদি।

এঞ্জেলা গোমেজ তাঁর সমাজ সেবামূলক কাজের জন্য অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে- শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী পুরস্কার (১৯৮৮), ডা. এম আর খান ও আনোয়ারা ট্রাষ্ট স্বর্ণপদক (১৯৯২), পাক্ষিক অনন্যা পুরস্কার (১৯৯৭), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৯), র‌্যামন ম্যগসেসে পুরস্কার (১৯৯৯), শ্রেষ্ঠ সমাজকর্মী পদক (২০০১), হস্তশিল্পে জাতীয়ভাবে চারবার (১৯৮২, ’৮৫, ’৮৬, ’৮৮) স্বর্ণপদক এবং ১৯৮৯ সালে রৌপ্যপদক পেয়েছেন তিনি।

বাবা আগস্টিন গোমেজ এবং মায়ের নাম ইসাবেলা৷ ৯ ভাই বোনের মধ্যে এঞ্জেলা সপ্তম। দরিদ্র বাবা-মায়ের ঘরের সন্তান তিনি। তাঁর মতো মেধাবী, নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার সচেতন মানুষের সংখ্যা সমাজে অনেক বিরল। তাঁর বাবা-মায়ের দেয়া নাম কেলিসিতা (আনন্দদানকারী) ও এঞ্জেলা (স্বর্গীয় দূত) সত্যিই স্বার্থক।  এঞ্জেলা গোমেজ আজ সমাজের মানুষকে স্বর্গীয় দূত হিসেবে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছেন।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুলাই ২০১৯/হাকিম মাহি