সাতসতেরো

ম্যান্ডেলা দিবসে শুভেচ্ছা

হাকিম মাহি: ‘আমি জাতিগত বৈষম্যকে তীব্রভাবে ঘৃণা করি এবং তার সকল প্রকাশ ভঙ্গিকে। আমি আমার সারাজীবন এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছি। আমি এখনো যুদ্ধ করছি এবং আমার মৃত্যু অবধি যুদ্ধ করবো।’ তিনি পরের বৃহত্তর স্বার্থে নিবেদিত প্রাণ, দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি, বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি মাদিবা বা ‘জাতির জনক’ হিসেবে পরিচিত।

বিশ্বপ্রেমিক হিসেবে খ্যাত ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই আজকের এই দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার এমভেজোর এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ও উইটওয়াটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র ছিলেন। পড়ালেখা শেষে ম্যান্ডেলা জোহানেসবার্গে আইন পেশাকে বেছে নেন। সেই সময়ে আফ্রিকায় চরম উপনিবেশবাদ বিদ্যমান ছিলো। তিনি তার বিরুদ্ধাচারণ করেন এবং আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

ম্যান্ডেলা মনে করেছিলেন, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় করতে হলে ক্ষমতায় আসতে হবে। তাই ১৯৪৩ সালে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের হয়ে রাজনীতি জীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে ইয়ুথ লিগ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৪৮ সালে আফ্রিকায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বর্ণবাদে বিশ্বাসী দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। তখন ম্যান্ডেলা দেখলেন, ন্যাশনাল পার্টি সাদা বর্ণের মানুষের থেকে কালোদের আলাদা করে রাখছে। এ অবস্থা তাঁকে গভীর পীড়া দেয়। ম্যান্ডেলা  নিজেও একজন কালো বর্ণের মানুষ ছিলেন। তাই তিনি কালোদের অধিকার আদায়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।। ম্যান্ডেলা রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগে ভারতীয় উপমহাদেশের অহিংস আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধির দর্শন অনুসরণ করেন। কিন্তু পরে তিনি উপায়ন্তর না দেখে সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল পার্টি নেলসন ম্যান্ডেলার আন্দোলনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালে তাঁকে বর্ণবাদী সরকার গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করে। তাঁকে নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। ম্যান্ডেলা দীর্ঘ ২৭ বছর কারাবরণ করেন। অধিকাংশ সময়ই তাঁকে রবেন দ্বীপে নির্বাসনে রাখা হয়। এরপর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁর কারাজীবন শেষ হয়। মুক্ত হয়ে ম্যান্ডেলা তাঁর দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। এই শান্তি আলোচনার মধ্যদিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান হয়। কালোরা পান ভোটের অধিকার। ১৯৯৪ সালে সকল বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে ম্যান্ডেলা নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এভাবেই আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আফ্রিকায় প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার দলের নাম ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’।

 

গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক হিসবে গণ্য ম্যান্ডেলা ২৫০টিরও বেশি পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর দীর্ঘ জীবনের আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৩ সালে ম্যান্ডেলাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে ভারতরত্ন পুরস্কারসহ ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারের অভিষেক পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন তিনি।

নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন ২০০৯ সালের ২৭ এপ্রিল সমগ্র বিশ্ববাসীকে ম্যান্ডেলা দিবস পালনের আহ্বান জানায়। এই দিনটিকে ছুটির দিন হিসেবে না রেখে তাঁরা নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শে সামাজিক সেবামূলক কাজের দিন হিসেবে পালন করার পরিকল্পনা নেন । এরপর ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে নেলসন ম্যান্ডেলার সম্মানে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নেলসন ম্যান্ডেলা আন্তর্জাতিক দিবস’ উদযাপনের জন্য ১৮ জুলাইকে ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিকভাবে ২০১০ সাল থেকে এ দিবস পালিত হয়।

নেলসন ম্যান্ডেলা শুধু অস্ত্র দিয়েই আন্দোলন করেননি। তিনি আন্দোলন করেছিলেন চিন্তা ও মনন দিয়ে। লিখেছিলেন প্রায় ২৭ টিরও বেশি বিখ্যাত গ্রন্থ। তারমধ্যে লং ওয়াক টু ফ্রিডম, স্ট্রাগল ইজ মাই লাইফ, ম্যান্ডেলা, প্রিজনার ইন দ্যা গার্ডেন, কনভারসেশন উইথ মাইসেলফ, ইন হিজ ওন ওয়ার্ডস ইত্যাদি।

ব্যক্তিজীবনে ম্যান্ডেলা তিন বিয়ে করেছিলেন। প্রথম স্ত্রীর সাথে সংসার জীবনে তার চার সন্তান হয় এবং পরে তাঁর বাকি দু’সন্তানের জন্ম হয়। তিনি রবেন দ্বীপের কারাগারে নির্বাসনে থাকাকালীন আফ্রিকান সরকার কর্তৃক শান্তি আলোচনার ডাক পেয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘বন্দি মানুষ কখনো শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে পারে না, শান্তি আলোচনার জন্য মুক্ত হতে হয়।’ আমৃত্যু তাঁর ধ্যান জ্ঞানই ছিলো মানুষের মুক্তি। সেই সংগ্রামী ম্যান্ডেলা ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের নিজ বাড়িতে ফুসফুস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুলাই ২০১৯/হাকিম মাহি