জাহিদ সাদেক : ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুঘল আমলে সুবেদার শাহ্ সুজার সময়ে নিজামতের দারোগা মীর মুরাদ স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ১৬৪২ সালে ঢাকায় হোসনী দালান স্থাপন করেন। এর আগে ১৬০০ সালে সূত্রাপুরে বিবিকা রওজা হযরত মা ফাতেমা (রা.) স্মৃতিগৃহ স্থাপিত হয়েছিল।
ঐতিহাসিক দানী লিখেছেন, মুঘল আমল থেকে ১০ মহররম ধর্মীয় শোক মিছিল (জলুস) বের হওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে ঢাকা শহরে। যাকে বলা হয় মঞ্জিলের (শেষ) মিছিল। এর আগে দুটি মিছিল বের হয়। তা হলো ৮ তারিখ ‘সামরাত কি মিছল’ বা ‘সন্ধ্যার মিছিল’ এবং ৯ তারিখ ‘ভোররাত কি মিছিল’ বা ভোররাতের মিছিল। মহররমের ১০ তারিখ সকালে প্রধান মিছিলটি বের হয় হোসনী দালান ইমামবাড়া থেকে। ঢাকার আরো কয়েকটি স্থানে ইমামবাড়া ছিল। আজিমুশশান উল্লেখ করেছেন, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছেও একটি হোসনী দালান ছিল। ১৮৬৯ সালে ঢাকার মানচিত্রে এই দালান দেখা যায়। এছাড়া ফুলবাড়িয়ার কাছে ছিল মীর ইয়াকুবের হোসনী দালান। আরও দুটি পুরনো হোসনী দালান ছিল ছোট কাটরা এবং মুকিম কাটরা।
বর্তমান যে হোসনী দালানটি আমাদের কাছে পরিচিত তার প্রতিষ্ঠা তারিখ এবং প্রতিষ্ঠাতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে বলা হয়, স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে সুবাদার মোহাম্মদ আজমের সময় মীর মুরাদ বর্তমান হোসনী দালানের জায়গায় ইমামবাড়া নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন নওয়ারা মহলের দারোগা এবং অট্টালিকাসমূহের তত্ত্বাবধায়ক। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে নায়েব নাযিম জেরাসত খান এটি পুনরায় নির্মাণ করেন। জেমস টেলর-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, ঢাকা নায়েব নাজিম বছরে আড়াই হাজার টাকা পেতেন মহররমের সময় হোসনী দালানে উৎসব পালনের জন্য। আলম মুসাওয়ার নামে এক চিত্রশিল্পীর ৩৯টি ছবিতে দেয়া যায়, নবাবী আমলে ঢাকায় মহররমের চিত্র। এতে একটি ছবিতে দেখা যায়, হোসনী দালানকে সাজানো হয়েছে। এর চত্ত্বরে বসেছে মেলা। সেখানে হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের লোকই আছেন।
কবি শামসুর রাহমান আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন চল্লিশের দশকের মহররমের মিছিলের কথা। তিনি বলেছেন, মহররমের মিছিল খুব ভালো লাগত! চকে মিছিল হতো মাঝরাতে। নানীর সঙ্গে যেতাম চকবাজারের একটি বাড়িতে মহররমের মিছিল দেখবো বলে।
তবে ঢাকায় মহররমের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো মেলা। মহররম উপলক্ষে মেলা বসে হোসনী দালান, বকশীবাজার, ফরাশগঞ্জ ও আজিমপুরে। তবে আজিমপুরের মেলাটিই সবচেয়ে বড়। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ‘স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী ঢাকা-১’ গ্রন্থে লিখেছেন, হোসনী দালান থেকে যে মিছিলগুলো বের হয় তার নিয়ন্ত্রণভার ঢাকাইয়া শিয়া এবং সুন্নিদের কাছে আর ফরাশগঞ্জের মিছিল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে সুন্নি মুসলমানেরা।
‘ঢাকাইয়া আসলি’ গ্রন্থে আনিস আহামেদ লিখেছেন, মহররমের আরেকটি বিশেষ কাজ হলো আখড়া স্থাপন। পুরনো ঢাকার নবাবগঞ্জ, গোড়ে শহীদ, মির্জ্জা মান্নার দেউরি, রহমতগঞ্জ, উর্দূ রোড জিন্দাবাহার, নিমতলী, বংশাল এলাকার লোকজন মহররম মাস শুরু হলেই আখড়া (ক্যাম্প) স্থাপন করত। তারপর লাঠি, ঢোল, তরবারি, বর্শা, অগ্নিগোলকের চরকি বানিয়ে নিজ নিজ মহল্লার অলিগলি প্রদক্ষিণ করে, তাজিয়া তৈরি ও ১০ তারিখের সিন্নির টাকা সংগ্রহ করত। তিনি আরো লিখেছেন, নিঃসন্তান দম্পত্তিরা সন্তানের আশায় হোসনী দালানে গিয়ে মানত করত- একে বলা হতো হোসেন কা বদ্দি। শিশু বয়সী ছেলেমেয়েদের কঠিন অসুখ হলেও বাবা মা রোগ মুক্তির জন্য বদ্দি মানবার নিয়ত করে থাকে।
মিছিলে থাকে বেহেশতা বা আলমে বারদার। তারা মহররমের মিছিলগুলো সবুজ ও লাল পতাকা বহন করে এবং ধর্মযুদ্ধের সৈনিকদেরকে ধারণ করে। মানত ও বংশানুক্রমে বেহেশতার সংখ্যা নির্ধারিত হয়। বেহেশতারা ৪টি দলে বিভক্ত হয়ে থাকেন। প্রত্যেক দলে একজন সর্দার নির্ধারিত হয়। এই সর্দাররা আমৃত্যু এ পদে বহাল থাকে। মিছিলে থাকে কাসেদ। তারা ইমাম হোসেনের বার্তা বাহক হিসেবেও পরিচিত। সারা গায়ে মোটা সাদা কালো ও সাদা সবুজ সুতলির মধ্যে অসংখ্য ঘণ্টা লাগিয়ে শরীরে প্যাঁচ দিয়ে রাখে। তাদের দ্রুতগতিতে দলবদ্ধভাবে মিছিলে হাঁটতে হয়। মোগবরা স্থাপন করে মহররমের প্রথম ১০দিন নিজ নিজ বাড়িতে আগরবাতি জ্বালানো হয়। ইমাম হোসেনের ভক্ত, বধূ, মাতা, কন্যারা এই মোগবরার চতুর্দিকে ঘুরে জারি পেটায় এবং ১০ মহররমে খিচুড়ি বিতরণ করে। মহররমের মিছিলের অন্যতম অনুষঙ্গ মর্সিয়া। হিন্দুস্থানী ভাষায় মর্সিয়া রজনা করে গাওয়া হতো। মহররমের মিছিলে মাতম চলাকালে শিয়া সম্প্রদায় যে শোকগাঁথা পাঠ করে তাকে নাওয়া বলা হয়। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ সেপ্টেম্বর ২০১৯/তারা