সাতসতেরো

বাকের ও খনি বিবির প্রেমের সাক্ষী

বাকরখানির ইতিহাস জানতে চাইলে ‘ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থের লেখক ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘জনশ্রুতি ধরে নিলে বাকরখানির ইতিহাস আগা বাকেরের সাথে সম্পর্কিত। জনশ্রুতি আছে, নর্তকী খনি বেগম এবং আগা বাকের পরস্পরের প্রেমে পড়েন। উজিরপুত্র নগর কোতোয়াল জয়নাল খানও ভালোবাসতো খনি বিবিকে। ফলে আগা বাকের ও জয়নালের সাথে যুদ্ধ হয় এবং জয়নাল হেরে যায়। প্রতিশোধ নিতে জয়নাল খনি বেগমকে তলোয়ারের আঘাতে হত্যা করে। বাকেরগঞ্জে সমাধিস্থ করা হয় খনি বেগমকে। পরে আগা বাকের সুবেদার মুর্শিদকুলি খানের মেয়ের জামাই হয়েছিলেন। ঢাকার মানুষ এই কাহিনীকে জীবিত রাখতে প্রিয় রুটির নাম রাখেন বাকরখনি। পরে তা পরিবর্তিত হয়ে বাকরখানি হয়েছে।’

পুরনো ঢাকার জনপ্রিয় খাবারের কথা বললে যার নাম প্রথমে আসে তা হলো বাকরখানি। ঢাকার ইতিহাস আর বাকরখানির ইতিহাস সমান বয়সী। ঢাকার ইতিহাস চারশ বছরেরও বেশি পুরনো। ধারণা করা হয় বাকরখানির সৃষ্টি হয়েছে আঠারো শতকের মাঝামাঝি। ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী খাবার দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকজন বাকরখানি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের ব্যবসা ভালো চলছে না। নারিন্দা মোড়ে বাকরখানির দোকান করেন আবুল বাসার। তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে আমরা প্রতি মাসে লাভ করতাম এখন আর এমন হয় না। কোনো মাসে লাভ হয়, কোনো মাসে হয় না।’ এর কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘আগে মানুষ ফাস্টফুডের প্রতি তেমন আগ্রহী ছিল না। তাছাড়া শ্রমিকের দাম বেড়েছে, বেড়েছে কয়লার দাম এবং দোকান ভাড়া। কিন্তু সে তুলনায় বাড়েনি চাহিদা বা বাকরখানি বিক্রি।’

সরেজমিনে দেখা যায়, বাকরখানি দুই ধরনের। একটি মিষ্টি, অপরটি মিষ্টি ছাড়া। খুচরা বিক্রিতে মিষ্টিগুলো ৪ টাকা আর মিষ্টি ছাড়া ৩ টাকা পিস। কেজিতে নিলে যথাক্রমে ১৪০ টাকা এবং ১১০ টাকা দরে বিক্রি হয়। দক্ষিণ মৈশুন্ডিতে বাকরখানির ব্যবসা করেন হবিগঞ্জের কাদের মিয়া। তিনি জানান, ৩০ বছর এই ব্যবসা করছেন। এখন আর আগের মতো লাভ হয় না। লাভ না হলেও কেনো এখনও ব্যবসা করছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক পুরনো ব্যবসা। মায়া পড়ে গেছে। অন্য ব্যবসা বুঝি না। তাছাড়া আমার বাবা-দাদার কাছ থেকে এ ব্যবসা শিখেছি। তাই বাদ দিতে পারি না।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় বাকরখানির যে দোকান আছে এর অধিকাংশ মালিকের বাড়ি হবিগঞ্জ বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। নারিন্দা, দৈক্ষিণ মৈশুন্ডি, দয়াগঞ্জ এলাকায় মোট ১৫টি দোকানের মধ্যে হবিগঞ্জের ৯টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩টি আর বাকি তিনটি অন্য এলাকার। এর কারণ জানা যায়, প্রথম দিকে হবিগঞ্জের লোকেরা ঢাকায় এসে রুটি তৈরির কাজ করত। একসময় তারা ছেলে, ভাই, স্বজনদের নিয়ে আসেন। পুরনো ঢাকার লোকেরাও এক সময় এর উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তবে মানুষের কাজের ক্ষেত্রের পরিবর্তন হচ্ছে, তাই হয়তো এখন আর তাদের এ পেশায় দেখা যায় না।

আগের বাকরখানির সঙ্গে এখনকার স্বাদের পার্থক্য কেমন জানতে চাইলে শরৎগুপ্ত রোডের প্রবীন বাসিন্দা হাজী একরাম বলেন, ‘আমাদের সময় বাকরখানি তৈরী হতো মাখন, ঘি দিয়ে। এর স্বাদ ছিল অতুলনীয়। এখন বাকরখানিতে এসব দেয় না। তোমরা যে বিখ্যাত বাকরখানির কথা বলো তা ছিল সেই সময়ে। এজন্য এখন আর নতুনরা এসব খেতে চায় না। তবে আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করা দরকার।’

কীভাবে বাকরখানি তৈরির ব্যবসায় এলেন- জানতে চাইলে লোহারপুলের ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী বলেন, ‘যখন আমার বয়স দশ, তখন আমার ভাই আমাকে ঢাকা শহরে নিয়ে এসে এই ব্যবসায় যুক্ত করে। এরপর ভাই বিদেশ চলে গেলে আমি এই ব্যবসা করছি আজ প্রায় ৪০ বছর।’ পুরনো ঢাকার নারিন্দা, দক্ষিণ মৈশুন্ডি, রায়সাহেব বাজার, দয়াগঞ্জ, নাজিম উদ্দিন রোড, সিদ্দিক বাজার, আলু বাজার, নয়া বাজার, চকবাজার, লালবাগে বাকরখানির দোকান বেশি দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চকবাজর আর নাজিমউদ্দিন রোডে। এখন কেমন বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে চকবাজারের ব্যবসায়ী হবিগঞ্জের নুরু মিয়া জানান- এখন গরম কাল তাই একটু বিক্রি কম। তবে শীতের সময় বেশি বিক্রি হয়।

বাকরখানি ক্রেতা নারিন্দার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাকরখানি তারা সকাল, বিকেল ও সন্ধ্যায় চা দিয়ে খান। মাংস, দুধ দিয়ে খেতেও বাকরখানির তুলনা হয় না। এতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল না থাকায় যাদের ডায়াবেটিস আছে তারাও খেতে পারেন।’ কালের অতলে হারিয়ে যাওয়ার আগে পুরনো ঢাকার এসব ঐতিহ্যবাহী খাবার সংরক্ষণ করা দরকার বলে মনে করেন ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক মোহাম্মাদ আজিম বক্স।

 

ঢাকা/তারা