সাতসতেরো

চারপাশে নদী, খাবার পানি নেই

সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। অথচ এই অঞ্চলেই পানির অভাব! এ যেন সমুদ্রের সেই নাবিকের গল্প- চারপাশে পানি কিন্তু খাবার পানি এক ফোঁটাও নেই।

পরিসংখ্যান বলছে, এ বিস্তৃর্ণ বনভূমিতে জনসংখ্যা চার মিলিয়নের বেশি। কিন্তু এর বেশির ভাগই স্থায়ী জনসংখ্যা নয়। যারা সুন্দরবনে থাকেন তাদের মধ্যে অধিকাংশ বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা কোস্টগার্ডের লোকজন। এছাড়া যারা থাকেন তারা বেশিদিন স্থায়ী থাকেন না। এদের মধ্যে রয়েছে ট্যুরিস্ট, গবেষক, মৌয়াল, বাওয়াল কিংবা জেলে। তারা খাবার পানির জন্য নানান কৌশল বের করেন। কেননা আশেপাশে নদী, নালার পানি লবণাক্ত। পুকুর খনন করলেও তা কিছুদিন পরই লবণাক্ত হয়ে পড়ে। এজন্য বৃষ্টির অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। তারা চাতকের মতো চেয়ে থাকেন আকাশ পানে- বৃষ্টির প্রতীক্ষায়।

সুন্দরবনে বসবাসকারী মানুষ ও পশুপাখির জন্য সুপেয় পানির পুকুর খনন করা হয়েছিল। আইলায় পুকুরগুলোতে লবণাক্ত পানি ঢুকে যায়। এতে জীব বৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ে। এছাড়া খাবার পানির জন্য তারা বেশ কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করে। এর মধ্যে রয়েছে লবণাক্ত পানি সোলার বেইস ফিল্টারের সাহায্যে বাষ্পে পরিণত করে সেই বাষ্পকে জারের মধ্যে আটকে পানের উপযোগী করা। এক্ষেত্রে সোলার প্যানেলের উপরে লবণাক্ত পানি রাখা হয়। সোলার প্যানেলের কারণে সূর্যের তাপে প্রতিদিন ৬ লিটার পানি বিশুদ্ধ করা হয়। আরেকটি পদ্ধতি হলো পাত-কূয়া পদ্ধতি। যাকে বলা হয় ‘পন্ডস অ্যান্ড ফিল্টার’ পদ্ধতি। ভূগর্ভস্থ পানিকে শোধন করে বিশুদ্ধ করা হয়। এক্ষেত্রে পুকুরের পানি কিংবা নালার পানি একটি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে কূয়ায় আনা হয়। সুড়ঙ্গের পথে দেয়া হয় পাথরের টুকরো। পাথরের টুকরোর সংস্পর্শে সেই লবণাক্ত পানির লবণাক্ততা দূর হলেও খুব বেশি পানের উপযোগী থাকে না। এ পানি গোসল বা নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।

গবেষণা থেকে জানা যায়, সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট ইছামতি, কপোতাক্ষ, শিবসা, পশুর, কাকশিয়ালী, রায়মঙ্গল, খোলাপটুয়া, কাজীবাছা, পানগাছি, ভদ্রা, শোলমারী, মরিচ্ছপ, মালঞ্চ প্রভৃতি নদীতে বর্তমানে লবণাক্ততার পরিমাণ নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিবছরই বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। সুন্দরবন অঞ্চলের সব নদীর পানিই বর্তমানে সমুদ্রের পানির লবণাক্ততার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সমুদ্রের পানি এখন সহজেই নদীতে প্রবেশ করছে এবং অনেক উজানে উঠে এসে দীর্ঘসময় স্থায়ী হচ্ছে। আবার সুন্দরবন অঞ্চলে ও সংশ্লিষ্ট নদীগুলোতে জোয়ারের সময় সমুদ্রের যে লোনা পানি ঢুকছে তার সবই ভাটার সময় বেরিয়ে যেতে পারছে না। বাঁধ ও চিংড়ি ঘেরসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর বাধায় এবং জলোচ্ছ্বাসেও প্রচুর লবণ পানি আটকে থাকছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে কম বৃষ্টিপাতের কারণেও ভূগর্ভের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে সমুদ্রের লোনা পানি মাটির শূন্যস্থান দ্রুত গ্রাস করছে। পরিবেশ অধিদফতরের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছর মার্চে রূপসা নদীর লবণাক্ততার মাত্রা ছিল যেখানে ৬.৮ পিপিটি, সেখানে মে মাসে তা ১২.২ পিপিটিতে উঠেছে।

কটকায় বন বিভাগের এক কর্মকতার মতে, চার-পাঁচ বছর আগেও সুন্দরবনের কটকায় বাঘ দেখা গেছে, এখন আর যায় না। এখন হয় বাঘ নেই অথবা বনের গভীরে সরে গেছে। সুন্দরবনের পানির গুণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে কাজ করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলছিলেন, সমগ্র সুন্দরবনের মধ্যে পশ্চিমের দিকে নোনার দাপট বেশি, পুবে কম অর্থাৎ কটকা একেবারে পুবে হওয়ায় এবং এখানে মিষ্টি পানির প্রবাহ থাকায় এখানে বাঘ বেশি থাকার কথা, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখানেই বাঘ কমে গেছে। তাহলে গোটা সুন্দরবনেই বাঘ কমবে, এটি খুবই স্বাভাবিক। নোনার দাপটে গোটা সুন্দরবনের প্রতিবেশব্যবস্থায় যে চিড় ধরেছে এমন কথা শোনা গেছে আগেই। এবার এক গবেষণায়ও জানা গেল- লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবনের পরিচয়বাহী বাঘের (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের বিচরণ এলাকা কমে আসছে।

লবণাক্ততা বাড়ার কারণ সম্পর্কে ড. মো. মনিরুজ্জামানের মতামত হলো- মিষ্টি পানির উৎস হচ্ছে পাহাড়বাহিত নদী এবং বৃষ্টির পানি। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া এবং উজানের নদীগুলো থেকে একেবারেই পানি না আসায় জোয়ারের চাপে সাগরের পানি বেশি চলে আসায় নোনার আধিক্য ধরা পড়ে। উপরন্তু পশ্চিম অংশে বিদ্যাধরী নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মিষ্টি পানির জোগান প্রায় বন্ধ। ফলে নোনার তেজ বেড়েছে। তবে লবণাক্ততার আধিক্য হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পশুপাখি। ঢাকা/তারা