সাতসতেরো

আন্দারমানিকের দুঃখ

যেখানে এক সময় ছিল মেঘনা নদী, জেলেরা বাইতো নৌকা, হতো ইলিশ শিকার; সেখানে এখন নদীর অস্তিত্ব নেই। প্রবল ভাঙনের মধ্য দিয়ে নদী গতি পরিবর্তন করে। প্রায় ৮০ বছর পূর্বে নদীর বুকে সৃষ্টি হয় একটি চর। চরটি জেগে ওঠার শুরুতে মানুষের তেমন বসতি ছিল না। তবে ধীরে ধীরে চর যখন বসতি স্থাপনের উপযোগী হয়ে ওঠে, তখন মানুষ সেখানে ঘর বাঁধতে শুরু করে।

মূলত চাষ এবং গরু-মহিষ পালনকারী মানুষ চরটিকে জীবিকার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়। মেঠোপথ আর সাঁকোর মাধ্যমে একসময় গড়ে ওঠে চরটির সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা। পিছিয়ে পড়া জনপদ সত্ত্বেও নদীভাঙনে বাড়ি-ঘর হারানো মানুষ, ভূমিহীন, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের বসাবসের শেষ আশ্রয় হয়ে ওঠে চরটি। চরটির নাম রাখা হয় আন্দারমানিক। কাগজে কলমে আজও তাই আছে।

আন্দারমানিক দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নে অবস্থিত। সৃষ্টির এতগুলো বছর পার হলেও আন্দারমানিকের দুঃখ ঘোঁচেনি। এখনো কাটেনি অন্ধকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন সুবিধা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রযুক্তির ছোঁয়া- সবকিছুর শূন্যতা আশপাশের গ্রামগুলোর চেয়ে এই গ্রামের পিছিয়ে পড়া প্রমাণ করে। আন্দারমানিক গ্রামের দিকে বয়ে চলা মেঠোপথ বহু আগে সংস্কার করা। কত আগে এই প্রজন্ম সে কথা জানে না। খুব সরু এই পথ দিয়ে কেবল সাইকেল, মোটরসাইকেল কিংবা সর্বোচ্চ সিএনজি চালিত অটোরিকশা চলতে পারে। বড় ধরনের কোনো যানের চলাচল নেই আন্দারমানিকে। ফলে এ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে দুর্ভোগ আর ভোগান্তির শিকার হতে হয়। উপরন্তু গর্তে গর্তে রাস্তাটি এতটাই ক্ষত-বিক্ষত যে মানুষের হেঁটে চলাও বড় দায়। রাস্তাটির উপর নির্মিত কালভার্ট রাস্তা থেকে ৬-৭ হাত উপরে।

গ্রামে গড়ে ওঠেনি কোনো সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র। দূরের কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা কাছের বাজারে ফার্মেসি এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্য সেবার একমাত্র বন্ধু। জেলা শহরে গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায় এখানকার মানুষের। যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই দুর্বল, সে কারণে শহরের চিকিৎসাসেবা এখানকার মানুষের কপালে জোটে না বললেই চলে।

তবে গ্রাম-বাংলার চিরায়ত রূপ আন্দারমানিকে বিদ্যমান। গেলে চোখে পড়ে খড়ের ছোট্ট ঘর থেকে ভেসাল জাল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য, বর্ষায় পানিতে ডুবে থাকা বিলের অপরূপ সৌন্দর্য, দিগন্তজুড়ে আমন ধানের চাষ কিংবা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। তবে গ্রামের সবচেয়ে বড় দুঃখ- কোনো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সেখানে নেই। এলাকাবাসী জানায়, স্থানীয় যুবকের উদ্যোগে এখানে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দক্ষিণ আন্দারমানিক এ জামান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। কিন্তু দেশে একসঙ্গে জাতীয়করণ হওয়া ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তালিকায় নেই স্কুলটির নাম। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে চারজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন। তারা কেউই বেতনভূক্ত নন। 

স্থানীয় শাহ আলম (৬০) বলেন, আমাদের এ গ্রামটি অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা একটি গ্রাম। গ্রামের শিশুরা সঠিক শিক্ষা না পেয়ে ইট-ভাটাসহ বিভিন্ন কাজ করছে। শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য সরকারি কোনো সহযোগিতাও নেই। গ্রামে এই স্কুলের কারণে মোটামুটি কিছু ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতে পারছে। আমাদের ভয় হয়, কবে যেন বিদ্যালয়টি আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে আন্দারমানিক আরো অন্ধকারে ডুবে যাবে।

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক লুৎফুর রহমান বলেন, আমাদের স্কুলের ৪-৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো সরকারি প্রাইমারি স্কুল নেই। গ্রামের শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম এটি। শত শত শিক্ষার্থীকে পাঠদান এবং শিক্ষকদের বেতনহীন বিদ্যালয় পরিচালনা করা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অন্যান্য সযোগ সুবিধা থেকেও আমাদের স্কুলের শিশুরা বঞ্চিত।

বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও আয়কর আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠার পর বিদ্যালয়টি ১৯৯৮ সালে অনুমোদন প্রাপ্ত হয়। কিন্তু প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের অসহযোগিতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের নাম থেকে ছিটকে পড়ে। পরে ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ বিষয়ক যাচাই-বাচাই কমিটি গ্রামের একমাত্র বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের জন্য মন্ত্রণালয়ে পুনঃসুপারিশ পাঠায়। কিন্ত সে সুপারিশের পর দীর্ঘ ৪ বছর অতিবাহিত হলেও আজও বিদ্যালয়টির জাতীয়করণের গেজেট প্রকাশিত হয়নি। স্কুলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত।

 

ঢাকা/ফিরোজ/তারা