সাতসতেরো

আজ মৃত আত্মারা ফিরে আসবে

আজ হ্যালোইন উৎসব। আয়ারল্যান্ডের মিথ অনুযায়ী, এ উৎসবে মৃত আত্মারা ফিরে আসে। বর্তমান আয়ারল্যান্ডে সেল্টিকরা ২ হাজার বছর পূর্বে বাস করত। তাদের বিশ্বাস ছিল, বছরের শেষ দিনটিতে পৃথিবী ও মৃত ব্যক্তিদের জগৎ এক হয়ে যায়। তখন মৃত ব্যক্তি এবং তাদের আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে। তারা যাতে ফসলের ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য ফিরে আসা আত্মাদের খুশি করতে ‘সাউইন’ উৎসব পালন করা হতো। সবাই একসঙ্গে আগুন জ্বালিয়ে, পশু বলি দিয়ে, শস্য দিয়ে আত্মাদের সন্তুষ্ট করতে চাইত।

‘হ্যালোইন’ বা ‘হ্যালোউইন’ শব্দটি এসেছে স্কটিশ ভাষার শব্দ ‘অল হ্যালোজ ইভ’ থেকে।  অর্থ ‘শোধিত সন্ধ্যা বা পবিত্র সন্ধ্যা’। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব খ্রিষ্টান চার্চ-এ উল্লেখ আছে, হ্যালোইন এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘পবিত্র সন্ধ্যা’। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে ‘হ্যালোজ ইভ’ শব্দটি এক সময় ‘হ্যালোইন’-এ রূপান্তরিত হয়। পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ‘হ্যালোইন’ এক প্রকার ‘ভূতুড়ে’ বিষয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

ইউরোপের মিথ বিশেষজ্ঞ জিওফ্রে কেটিং-এর মতে, আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডবাসীদের সেল্টিক ডাকা হতো। তাদের ধর্মে সূর্য দেবতা  গুরুত্বপূর্ণ এবং শীতকালকে ধরা হয় বছরের সবচেয়ে খারাপ সময়। যেহেতু শীতকাল তাদের কাছে ভয়ঙ্কর এবং অক্টোবর মাসের শেষ থেকে শীত পড়তে শুরু করে, ফলে তারা মনে করে খারাপ সময়ের শুরু হলো। শুধু তাই নয়, অক্টোবরের শেষ রাতকে তারা সবচেয়ে খারাপ রাত মনে করে। এই রাতে প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মা ফিরে আসে। এদের সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে ক্ষতি হতে পারে। যে কারণে তারা এই রাতে বিভিন্ন রকম ভূতের মুখোশ ও কাপড় পরে কাটায়। সবাই একসঙ্গে আগুনের পাশে মুখোশ পরে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র উচ্চারণ করে। এমনকি পরিবার ছোট হলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে কাটায়। মূলত পুরো বিষয়টি তারা সামাজিকভাবে একত্র হয়ে পালন করে।  হ্যালোইন উৎসব শুরু থেকেই এভাবে পালিত হয়ে আসছে। 

তবে হ্যালোইনের শুরুটা হয়েছিল সেই প্রাচীন রোমান সভ্যতায়। রোমে নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসবের নাম ছিল ‘সাউইন’ (The ancient Celtic festival of Samhain)। হ্যালোইন পালিত হতো মূলত নতুন ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষে। জিওফ্রে কেটিংয়ের মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩ শতকে অধিকাংশ সেল্টিক অঞ্চল রোমান সম্রাটের আওতায় চলে যায়। তারা ৪০০ বছর সেল্টিক অঞ্চল শাসন করে। তখন সেল্টিকদের ‘সাউইন’ উৎসবের সঙ্গে রোমানদের একটি উৎসব যৌথভাবে পালন করা হতো। সেখানে অবশ্য সাউইনের প্রাধান্য বেশি ছিল।

আয়ারল্যান্ডের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ কেভিন ড্যানহার তার ‘দ্য ইয়ার ইন আয়ারল্যান্ড’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘৪৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেল্টিক এলাকা রোমানরা দখল করে নেয়ার পর তাদের দুটি উৎসব সাউইনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে। একটি হচ্ছে ফেরালিয়া- মৃতদের স্মরণের দিন এবং অন্যটি পোমোনা দেবীকে স্মরণের দিন, যার প্রতীক হচ্ছে আপেল। আর এখান থেকেই হ্যালোইনের সময় বালতির পানিতে ভাসানো আপেল মুখ দিয়ে তোলার রেওয়াজ শুরু হয় যা ‘ববিং ফর অ্যাপলস’ নামে পরিচিত।

এস কে এনজেলিস এর ‘গ্রিক মিথলজি’ থেকে জানা যায়, হ্যালোইন সেল্টিক জাতির একটি পূজা উৎসব। এরা লৌহযুগের পৃথিবীতে ইন্দো-ইউরোপীয় একটি জাতি। বর্তমান আয়ারল্যান্ড ও ফ্রান্সের উত্তরাংশেই এককালে এদের গোড়াপত্তন হয়। তারা ছিল মূর্তিপূজক ও বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এদের বছর শুরু হতো ১ নভেম্বর আর শেষ হতো ৩১ অক্টোবর। একই সঙ্গে  অক্টোবরকেই তাদের গ্রীষ্মের শেষ সময় ধরা হতো এবং নভেম্বর ছিল শীতের শুরু। তাদের ধারণা ছিল, গ্রীষ্মের শেষে খারাপ আত্মাগুলো পৃথিবীতে চলে আসার কারণেই ফসল ফলে না, গাছের পাতা শুকিয়ে যায়, গাছ মারা যায়, চারপাশের সবকিছু মৃত আর ঠান্ডা হয়ে যায়। তারা এও বিশ্বাস করত, মৃতদের আত্মা ত্রিকালজ্ঞ। অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সবকিছু জানে। সেল্টিকরা ভাবত, খারাপ আত্মাগুলো ফসল না ফলার জন্য দায়ী। তাই এই রাতে খারাপ আত্মাদের সন্তুষ্ট করতে পারলে সেল্টিকদের প্রধান পুরোহিতরা তাদের মাধ্যমে ভবিষ্যতের ফসল-ফলাদি আর চাষাবাদের ব্যাপারে সম্যক ধারণা পাবে। খারাপ আত্মাগুলো যেন তাদের কোনো ক্ষতি না করতে পারে এই ভেবে উৎসবের পুরোটা সময় সেল্টিকরা অদ্ভুত সব পোশাক আর মুখোশ পরত; একটা ছদ্মবেশে থাকত। পোশাকগুলো হতো কল্পিত ভূত-প্রেতের মতো। সেল্টিকরা এ কাজ করত এই ভেবে, তারা যদি ভূত-প্রেতের পোশাক পরে ছদ্মবেশ নেয় তবে ওপার জগৎ থেকে আসা খারাপ আত্মাগুলো তাদের চিনতে পারবে না। ফলে খারাপ আত্মাদের দ্বারা তাদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। পাশাপাশি তাদের পুরোহিতরা একটি অন্ধকার ওক (পবিত্র গাছ হিসেবে বিবেচনা করা হতো) বনে মিলিত হতো বনের ছোট পাহাড়ে নতুন আগুন জ্বালানোর জন্য এবং তারা সেখানে বীজ ও প্রাণী উৎসর্গ করত।

এস কে এনজেলিস-এর বর্ণনায় জানা যায়, অষ্টম শতকে খ্রিষ্টান চার্চ ‘সাউইন’ উৎসবকে ‘অল সেইন্ট’স ডে’ হিসেবে রূপান্তর করে। যা ‘অল হ্যালোস’ বা ‘সাধুদের দিবস’ নামে পরিচিত। আর হ্যালোইনে ‘ট্রিক অর ট্রিট’-এর  জন্য দায়ী মধ্য যুগের ব্রিটেনের অধিবাসীরা। তাদের ‘সৌলিং’ ও ‘গাইজিং’ প্রথাই বর্তমানে ট্রিক অর ট্রিট হিসেবে প্রচলিত। তাদের মতে ২ নভেম্বর হচ্ছে ‘অল সৌলস ডে’ বা ‘সকল আত্মার দিবস’। এই দিনে দরিদ্রের জন্য পিঠা বানানো হতো। যার নাম ‘সৌল কেক’। দরিদ্ররা যে পরিবারের কেক খেতো, সেই পরিবারের মৃত মানুষের আত্মার জন্য প্রার্থনা করত। এটাই সৌলিং।

অন্যদিকে রক্ষণশীল প্রোটেস্ট্যান্ট বিশ্বাসের কারণে দীর্ঘসময় হ্যালোইন ঔপনিবেশিক নিউ ইংল্যান্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আমেরিকায় অনেক নতুন অভিবাসী আসে। এর মধ্যে ‘আইরিশ পোট্যাটো ফেমিন’র কারণে লক্ষাধিক আইরিশও আমেরিকায় অভিবাসী হয়। পরবর্তীতে তারাই আমেরিকাজুড়ে হ্যালোইন জনপ্রিয় করে তোলে। ১৯৩০-এর দশকে হ্যালোইন কস্টিউম আসা শুরু করে আর ৫০-এ আসে ‘ট্রিক-অর-ট্রিট’ আর তখন থেকেই পারিবারিকভাবে হ্যালোইন পালনের শুরু। এই রাতে নারী পুরুষ বিশেষ করে শিশুরা বিচিত্র ভূতের পোষাক পরিধান করে। সন্ধ্যায় বাড়ির আঙ্গিনায় ভৌতিক আবহ আনার জন্য মাকড়সার কৃত্রিম জাল, মিষ্টি কুমড়োর মধ্যের সব কিছু বের করে বিভিন্ন ভৌতিক ডিজাইন করে এর মধ্যে আলো জ্বালিয়ে রাখে। বাড়ির আলো নিভিয়ে দিয়ে একটি ভৌতিক পরিবেশ আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে অন্যতম একটি ছুটির দিন হ্যালোইন। ঢাকা/মারুফ/তারা