সাতসতেরো

মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু বিমান ছিনতাইকারী জ্যঁ ক্যুঁয়ে

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। আর যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমার স্বাধীনতা অর্জন করেছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমেই তাদের স্মৃতি চিরজাগরুক হয়ে থাকবে আমাদের প্রতিটি বাঙালির মনের মনিকোঠায়।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তা শুধু এই উপমহাদেশেই নয়, বরং পুরো বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন তিনি সেখান থেকেই তার সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম আর তার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন।

বিশেষ করে যারা কোনো দিন বাংলাদেশকে চিনতেন না সেসব বিদেশি অনেক বন্ধু আমাদের মুক্তি সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। কেউ কেউ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বিশ্ব বিবেককে আহ্বান জানিয়ে নানা কর্মসূচী পালন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র আর যুদ্ধের রসদ যোগাতে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। এদের কয়েকজনকে নতুন করে স্মরণ করছি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে।

১৯৭১ সালে প্রায় শূন্য হাতে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে হানাদার বাহিনী অনেকটাই নাস্তানাবুদ। এমন সময় প্যারিসের অধিবাসী, ২৮ বছরের টগবগে এক যুবক জ্যাঁ কুঁয়ে একটি দু:সাহসী কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান এয়ার ওয়েজের (পিআইএ) ৭২০বি উড়োজাহাজটি ফ্রান্সের অর্লি বিমানবন্দর থেকে ছিনতাই করে বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দেন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকান্ডের কথা বিশ্বব্যাপী সবাই জেনে যায় সংবাদমাধ্যম থেকে। জ্যাঁ কুয়েও বিষয়টি জানার পর চিন্তা করছিলেন কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা যায়। তিনি পাকিস্তানের একটি বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। এ নিয়ে বহু চিন্তা ভাবনার পর মনস্থির করেন বিমানবন্দরে সবাই যখন ব্যস্ত থাকবেন সেই সময়ই কাজটি করতে হবে। এরপর বিমানবন্দরের সব কিছু নজরদারি করতে থাকেন।

অনেক অপেক্ষার পর তার প্রত্যাশিত দিনটি আসে। বিমানবন্দরে সেদিন আসার কথা জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডিট এবং ফরাসি রাষ্ট্রপতি পম্পিডু। দু'জন ভিআইপিকে নিয়ে নিরাপত্তারক্ষী এবং বিমান বন্দরের অন্যরা ব্যস্ত থাকবে, আর সে সুযোগেই তিনি ঢুকে পড়বেন এটাই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। অবেশেষে পেয়ে যান সেই মহেন্দ্রক্ষন।

পিআইএ'র ৭২০বি উড়োজাহাজটিতে যাত্রীবেশে ঢুকে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ককপিটে ঢুকে পড়েন তিনি। তিনি ককপিটে ঢুকেই পাইলট আর কো-পাইলটের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে ঘোষণা দিলেন বিমানটি ছিনতাই হয়েছে এবং কেবলমাত্র তাঁর দাবী পূরণ করা হলেই বিমানটি রক্ষা পাবে।

এ সময় জ্যাঁ কুয়ের বুকে ছিল একটি ব্যাগ, সেটি দেখিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি শক্তিশালী টাইমবোমা। আমার দাবি মানা না হলে এটির সুইচ টিপে ফাটিয়ে ফেলা হবে। এতে যাত্রীসহ পুরো বিমান ধ্বংস হবে। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি বিমানবন্দরসহ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

২৮ বছরের এক যুবক ছিনতাইকারী। তার দাবি আর কিইবা হতে পারে! কাড়ি কাড়ি টাকা, সম্পদ এই তো! কিন্তু সকলেই ভীষণ হতবাক হয়ে পড়ে তাঁর দাবীকৃত মুক্তিপণের বিষয়টি শুনে। মুক্তির পণ হিসেবে তিনি যা চেয়েছিলেন সেটা সেদিনের প্রেক্ষাপটে, মানব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তো অবশ্যই অতি আশ্চর্যের বিষয়।

জ্যাঁ কুয়ে সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানী হানাদার আর তাদের দোসরদের ভয়ে বাংলাদেশ নামে একটি পরাধীন দরিদ্র দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। কুঁয়ে ছিনতাইকৃত বিমানের বদলে চাইলেন অসহায় মানুষগুলোর জন্য মেডিকাল যন্ত্রপাতিসহ ২০ টন ঔষধ এবং যথাযথ পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হতাহতের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে জেনে এই যুবকের প্রাণ বারবার কেঁপে উঠেছে। তাঁর মন এই মানুষগুলোর মানবেতর জীবনের কথা ভেবেছে। কিন্তু নিজের পরিণতির কথা একবারও ভাবেননি। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন ধরা পড়লে অথবা ব্যর্থ হলে তাঁর নিয়তি। জানতেন কাজটিতে ঝুঁকির মাত্রাও।

তবুও জ্যাঁ কুয়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেননি। হাজার মাইল দূরের ভিনদেশী এই ফরাসী যুবক, অজানা অচেনা এক পরাধীন বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁর জীবন বাজি ধরলেন। মানবিকতা এবং তিনি মানুষ, এ ছাড়া তাঁর আর কোনো দায়িত্বই ছিল না।

বিমানটির দখল নেওয়ার পর আশ্বস্ত করা হয় তার দাবি মেনে নেয়া হবে। এই আশ্বাস দিয়ে রেডক্রসের কর্মী এবং উড়োজাহাজের টেকনিশিয়ান হিসেবে দুজন কর্মী বিমানে ঢুকে পড়ে। আসলে তারা ছিল ছদ্মবেশী পুলিশ। তারা কৌশলে জ্যাঁ কুঁয়েকে বিমান থেকে নামিয়ে আনে।

এক পর্যায়ে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। আর বুকে ছোট ব্যাগে বোমা আছে উল্লেখ করে সেটি বিস্ফোরণ ঘটাবেন বলে যে ভয় দেখিয়েছিলেন সেই ব্যাগে পাওয়া গেল দুটো ডিকশনারি ও একটি বাইবেল।

এরপর জ্যাঁ কুঁয়ের বিচার করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হলো। কিন্তু সে সময়ে যত সাক্ষী ছিলেন এবং যারা এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাঁরা প্রত্যেকে সাক্ষ্য দিলেন, জ্যাঁ কুঁয়ে যা করেছেন তা মানবতার জন্য, মানুষের জন্যই। কারো ক্ষতি করেননি এবং আদতে তা করতেও চাননি, সে উদ্দেশ্য তাঁর ছিলও না।

তবুও শেষ রক্ষা হলো না। ফরাসি সরকার সেদেশের আইন অনুযায়ী তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে ক্যুঁয়ের দাবি অনুযায়ী ফ্রান্স সরকার বাংলাদেশকে ২০ টন মেডিকাল সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল। ঢাকা/এনএ