সাতসতেরো

জেনারেল জ্যাকবের ধোকা এবং রুদ্ধশ্বাস ৩০ মিনিট

একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর সকাল। আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের দিন। বিজয়ের গল্প আমরা সবাই জানি, আমরা কি ভেতরের গল্পটা জানি?

১৫ ডিসেম্বর থেকেই ঢাকা ঘিরে রেখেছে শত-শত, হাজার-হাজার মুক্তিযোদ্ধা। এদিকে নিয়াজির নেতৃত্বে ২৭,০০০ পাকিস্তানি সেনাও তখন ঢাকায়।

আত্মসমর্পণের দলিলের একটা খসড়া নিজেই তৈরি করেছিলেন জেনারেল জ্যাকব। দিল্লির সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই! তার হাইকমান্ডের নির্দেশনা ছিল চট্টগ্রাম আর খুলনা দখল করা। ভারত সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানকে ইউএন রেগুলেশনের আওতায় যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য করা। এদিকে পাকিস্তানেরও মানসিক প্রস্তুতি ছিল ইউএন রেগুলেশনের আওতায় যুদ্ধবিরতির দিকে যাওয়া। মাঝখানে কেবল শর্তগুলো নিয়ে দর কষাকষির কারবার চলছিল। কিন্তু এই পাগল লোকটা তখন অন্য পরিকল্পনায় হাঁটছিলেন।

কোনো প্রটেকশন ছাড়াই চলে গেলেন নিয়াজির কাছে। সোজা জানিয়ে দিলেন ‘যুদ্ধবিরতি নয়, এই উন্মুক্ত আত্মসমর্পণের দলিল আধঘণ্টার মধ্যে মেনে নিতে। নইলে ঢাকায় আমরা এক্ষুণি বম্বিং শুরু করব। মুক্তিবাহিনী তোমাদের প্রতিটি সৈন্যকে হত্যা করবে। মারা পড়বে সৈনিকদের স্ত্রী-শিশুরাও। আর মেনে নিলে আপনার সব সেনার সুরক্ষার দায়িত্ব আমার। তাদের গায়ে কেউ হাত দেবে না!’

নিয়াজি হতভম্ব হয়ে বসে আছেন। জ্যাকব তখন দলিলের খসড়াটা তিনবার তার চোখের সামনে দোলালেন। বললেন, ‘তুমি চুপ করে থাকলে আমি ধরে নেবো তুমি এটা মেনে নিচ্ছ। সাথে এটাও জেনে রাখ যে, এই আত্মসমর্পণ হবে একটা পাবলিক আত্মসমর্পণ এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাপ্রধানকে গার্ড অফ অনার দেবে’ বলেই ব্যাস কোমরে পিস্তল ঝুলিয়ে যেমন নাটকীয়ভাবে ঢুকেছিলেন, সেভাবেই বেরিয়ে গেলেন।

জেনারেল জ্যাকব নিয়াজিকে বুঝতেই দিলেন না যে ঢাকায় তার হাতে মাত্র হাজার তিনেক সেনা ছিল। শুধু ঢাকাতেই পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা তখন ভারতীয় সেনার প্রায় নয়গুণ! সাতাশ হাজারের কাছাকাছি। আত্মসমর্পণ না-করেও তারা অনায়াসে আরও অন্তত দু’সপ্তাহ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত। ততদিনে জাতিসংঘের আলোচনায় কী ফল হয় অপেক্ষা করা যেত তার জন্যও। কিন্তু জ্যাকব এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন যে, ঢাকার পতনের আর এতটুকু দেরি নেই। আত্মসমর্পণ না করলে জেনারেল নিয়াজি ও তার সঙ্গীদের মৃত্যু অবধারিত।

আর এ কারণেই ভারতের বিখ্যাত সামরিক গবেষক ও ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের কর্ণধার, সাবেক মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জি মনে করেন, জ্যাকব নিয়াজির সঙ্গে যা করেছিলেন তা বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ‘ব্লাফ’ বা ‘ধোকা’গুলোর একটা।

তিনি বলছিলেন, ‘এমন একটা ব্লাফ দিয়ে তিনি পাকিস্তানিদের ওপর সাংঘাতিক একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করতে পেরেছিলেন। যে কারণে তারা বেশ অপ্রত্যাশিতভাবেই আত্মসমর্পণে রাজি হয়ে যায়। তারা বোঝেওনি যে ভারতের সঙ্গে মাত্র তিন হাজার সেনা আছে। এর পেছনে আমি পুরো কৃতিত্ব দেব জ্যাকবের বুদ্ধিমত্তাকে। কারণ পাকিস্তানিদের কিন্তু তখন সারেন্ডার না করলেও চলত।’

পরে যুদ্ধের তদন্তে গঠিত পাকিস্তানে জাস্টিস হামিদুর রহমান কমিশন যখন নিয়াজিকে প্রশ্ন করেছিল প্রায় সাতাশ হাজার সেনা সঙ্গে নিয়েও তিনি কেন আত্মসমর্পণ করলেন। তখন নিয়াজি বলেছিলেন ‘জ্যাকব আমায় ব্ল্যাকমেল করেছে। আমার পরিবারকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারার হুমকি দিয়েছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

পাকিস্তানি জেনারেলের আশা ছিল, বড়োজোর যুদ্ধবিরতি হবে আর সেই যুদ্ধবিরতিটাও হবে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে। তখন জাতিসংঘের অধিবেশন চলছে নিউইয়র্কে, পাকিস্তানি কূটনীতিকরা জোর তদবিরও চালাচ্ছেন। বিভিন্ন দেশ নানারকম যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনছে। অনেক প্রস্তাব ভেটোতে উড়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানের আশা ছিল আমেরিকান নৌবহরের, আশা ছিল চীনের সহায়তার। এদিকে রাশিয়ার বাংলাদেশের দিকে হার্ডলাইনে যাওয়ার কারণে আর কোন দেশই পাকিস্তানকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিল না। তবে যতটুকুই ছিল নিয়াজির তা দিয়ে ১০-১২দিন যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে পারতো তারা।  কিন্তু জ্যাকবের ভাবটাই এমন ছিল যে, এই মুহূর্তে তার কথা মেনে না নিলে সবাই মারা পড়বে।

জানা যায় আত্মসমর্পণের দলিলে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি রাখতে চায়নি পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু জেনারেল জ্যাকব বলেছিলেন, ‘দিল্লী থেকে বিষয়টি এভাবেই এসেছে। এটি এমন করেই রাখতে হবে।’ যদিও জানা যায় খসড়াটি তিনিই তৈরি করেছিলেন। আজ দেখা যায় দলিলে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি থাকার কারণে বহু বিতর্ক ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সংগঠিত করতে জেনারেল জ্যাকব জেনারেল নাগরাকে দুটি চেয়ার, একটি টেবিল জোগাড় করতে এবং ঢাকা শহর বিমানবন্দর, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ও একটি যৌথ গার্ড অব অনারের আয়োজন করতে বললেন। তারপর পাকিস্তান বাহিনী ৩০মিনিট সময়ে এক বিনাচুক্তির আত্মসমর্পণ সম্পন্ন করে।

যদি জ্যাকব ধরা পড়ে যেতেন তাহলে কী হতে পারতো? যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতো। আরও অনেক নিরীহ মানুষ মারা পড়তো। আর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কোনো সুযোগই থাকতো না। ফলে একসময় যুদ্ধ-বিরতি হলেই বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই আরও বহু বছর চালিয়ে যেতে হতো। কারণ অনেক বিশ্লেষকই বলেছেন, জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির আওতার পড়লে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বপ্ন হয়তো স্বপ্নই থেকে যেত। কারণ জাতিসংঘের সুপারপাওয়ার দেশগুলোর অধিকাংশই তৎকালীন সময়ে ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।

ভয়াবহ গণহত্যা, বিশ্ব মোড়লদের প্রবল চাপের মুখে ঈশ্বর যেন ত্রাতা হিসেবে জেনারেল জ্যাকবকে পাঠিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে মারা যান জেনারেল জ্যাকব। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করব তাঁকে। ঢাকা/তারা