সাতসতেরো

একটু উষ্ণতার জন‌্য

মানুষ সামাজিক জীব। জীবসত্তা কাজে লাগিয়ে মানুষ তার সামাজিক সত্তা বিকশিত করেছে। এই সামাজিক সত্তাই তাকে অন্যান্য প্রাণি থেকে আলাদা করেছে।

তারপরও মানুষের কারণেই প্রকৃতি এবং বন‌্যপ্রাণির যেমন ক্ষতি হচ্ছে, আবার এই মানুষই পরম মমতায় কোলে তুলে নিচ্ছে অসহায় প্রাণিদের। বিশ্বস্ত প্রাণি হিসেবে কুকুরের সুনাম রয়েছে।  প্রভু-ভক্তির জন্যও কুকুর বিখ্যাত। এছাড়াও ঘর-বাড়ি পাহারায় কুকুরের ব্যবহার প্রায়ই দেখা যায়। যান্ত্রিক এই দুনিয়ায় মানুষ যখন মানুষের ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে তখন রাজধানীর ফুটপাতে কুকুর হয়ে উঠেছে এক পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী।

মিরপুর রোড থেকে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে প্রবেশমুখের ঠিক পূর্বেই রয়েছে সিটি করপোরেশনের সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন। এর পাশেই ফুটপাতে থাকেন মো. খায়রুল ও তার পরিবার। পরিবারে আছেন বাবা-মা ও এক বোন। ১৫ বছর বয়সি খায়রুল জন্মের পর থেকে এখানেই বড় হয়েছেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্য তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এরই মাঝে তাদের সঙ্গী হয়ে উঠেছে একদল কুকুর। কুকুরগুলো দামি কোন বিদেশি জাতের নয়। নয় সম্ভ্রান্ত ঘরের ‘ডগি’ কিংবা ‘পেট’। নিতান্তই নাম পরিচয়হীন রাস্তার কুকুর। তবুও এগুলোকে আপন করে নিয়েছেন খায়রুল। খায়রুলের দিন শুরু হয় পোষা কুকুরগুলোর সঙ্গে। ছোট-বড় মিলিয়ে তার কুকুর রয়েছে ১৮টি। এছাড়াও সদ্যপ্রসূত ৭টি বাচ্চা যোগ হয়েছে এই পরিবারে। শুধু খায়রুল নয়, গোটা পরিবারের অবসর কাটে কুকুরগুলোর সঙ্গে। এমনকি রাতে ঘুমাতে গেলেও বিছানার ভাগ দিতে হয় তাদের।

খায়রুল জানান, ফুটপাতে বিছানা পেতে ঘুমান তারা। বিছানা বলতে পলিথিনের ওপর পাতলা কাঁথা। শীতে গায়ে দেয়ার জন্য সাহায্য পাওয়া পাতলা একটি কম্বল ছাড়া অবিশিষ্ট কিছু নেই। রাতে ঠান্ডা বাতাসে একটি কম্বলে শীত পুরোপুরি যায় না। কুকুরগুলোও শীতের রাতে কষ্ট পায়। একটু উষ্ণতার আশায় কুকুরগুলোও তখন শরীরে ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। কখনও শরীরের উপর উঠে আসে অতি আদরের ছোট্ট শিশুর মতো। বিধাতা এভাবেই সেখানে মানুষ এবং কুকুরের ব‌্যবধান ঘুঁচিয়ে দিয়েছেন। যদিও আশপাশের সুউচ্চ দালানের বড় মানুষদের কাছে শীতের রাতে ফুটপাতের মানুষের সেই কষ্টের খবর পৌঁছায় না।

জানা গেল, প্রতিটি কুকুরের আলাদা নাম রয়েছে। জুলি, টাইগার, মাস্টার, রোমিও, ড্রাগন, জনি ইত‌্যাদি। নামগুলো বিভিন্ন সিনেমা থেকে ধার করা। খায়রুল জানায়, পার্শ্ববর্তী টিভির শো-রুমের কাঁচের বাইরে দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখে সে নামগুলো পেয়েছে। জুলি, রোমিও কিংবা ড্রাগন নাম ধরে ডাকামাত্র কুকুরগুলো সাড়া দেয়। এমনকি ছায়াসঙ্গীর মতো কুকুরগুলো তাকে অনুসরণ করে।  মাঝে মাঝে পিছু নেয় খায়রুলের মা তাসলিমা বেগমের। কিন্তু সে তখন কৌশলে কুকুরগুলোকে অন্য পথে নিয়ে যায়। কারণ তাসলিমা বেগম চান না কুকুরগুলো তার ভিক্ষাবৃত্তিতে সমস‌্যা তৈরি করুক। কুকুরের ভয়ে অনেকেই তাকে ভিক্ষা দিতে চান না।  অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সে একথা বুঝে ফেলেছে। 

কুকুর নিয়ে খায়রুল

 

খায়রুলের জন্ম ঢাকাতেই। এমনই এক ফুটপাতে-  যদিও জায়গাটির নাম সে জানে না। আক্ষরিক শিক্ষা বলতে কিছুই নেই। বাবা হারুন পেশায় ছিলেন রিকশাচালক। দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত লাগার পর এখন রিকশা চালাতে পারেন না। কাজ করেন পার্শ্ববর্তী সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে। সংসারে আয় বলতে এটুকুই।

সামান‌্য এই আয়ে খায়রুলের ভাগ‌্যে ছ’মাসে একবার মাংস না জুটলেও মুরুগির দোকান থেকে সে মাঝেমধ‌্যে চামড়া নিয়ে আসে কুকুরগুলোর জন‌্য। খায়রুলের ধারণা এর লোভেই কুকুরগুলো তার পেছনে ঘুরঘুর করে। তবে ফুটপাতের কাউকে কুকুরগুলো আক্রমণ করে না। এমনকি তার পরিবারের কেউ কখনও আক্রান্ত হয়নি।

কুকুর নিয়ে সংসার। মানুষ এবং কুকুরের একত্রে বাস। শখের ফটোগ্রাফারদের কাছে লোভনীয় বিষয় বটে। বিশেষ করে মানুষের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। ফলে শখের ফটোগ্রাফারের অভাব নেই। খায়রুল জানান, ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই আমাদের ছবি তুলে নিয়ে যায়। ফেইসবুকে পোস্ট করে। তাঁর ধারণা, তাদের অসহায়, গরিব বলে প্রচার করে অনেকেই সাহায্যের অর্থ জোগাড় করে। যদিও সেই সাহায‌্য কখনওই খায়রুলদের কাছে পৌঁছে না। তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে অর্থ আদায় করে অনেকে। এই প্রতিবেদকের তখন আর বলা হয় না- ফেইসবুকে তেমনই একটি সাহায্যের পোস্ট দেখে তথ‌্যগুলো সঠিক কিনা জানার জন‌্য খায়রুলকে খুঁজে বের করেছেন তিনি। ঢাকা/তারা