সাতসতেরো

স্কুলের জন‌্য আরমানের কান্না

হাজিরহাট বাজারের গলিপথ। পাশে আসবাবপত্র তৈরির কারখানা। হাতুড়ি-বাটালের শব্দ আসছিল সেখান থেকে। পলকেই অনুধাবন করা যায় কাঠমিস্ত্রীদের ব‌্যস্ততা।

ব‌্যস্ত পায়ে জায়গাটি পেরিয়ে আসতেই চোখ আটকে গেল এক মায়াবি চেহারায়। বয়স কত হবে- বারো। একমনে কাজ করছিল সে। অথচ চেহারায় বিমর্ষ ভাব। কোথায় যেন সুর কেটে গেছে।

কিছুক্ষণের জন‌্য দাঁড়ালাম। আশপাশে সবাই হাসছে, কথা বলছে, এমনকি পরস্পরের সঙ্গে কাজের ফাঁকে সরস মন্তব‌্যও করছে। কিন্তু বালকের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মাথা নিচু করে কাজ করছে। চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করলাম। সফল হলাম না। সবার মাঝে থেকেও সে কি নিজেকে আলাদা করে রাখতে চাইছে? কৌতূহল বাড়ল।

সাধারণত শিশুদের কাজ করতে দেখলে আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি। নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি। সঙ্গে ক‌্যামেরা থাকলে ছবিও তুলি। ক্যামেরা সঙ্গেই আছে। ছবি তুলব কিনা ভাবছিলাম। কিন্তু সাবজেক্ট নিজেই তো সাহায‌্য করছে না। এবার আমাকেই এগিয়ে যেতে হয়।  

জানতে চাই, ‘নাম কী তোমার?’

বালকের যেন সম্বিত ফিরল। মাথাটা সামান‌্য তুলে ছোট্ট করে বলল, ‘আরমান’।

‘কী করো তুমি?’

‘এই যে নকশা শিখি।’

খাট তৈরি হবে। কাঠ খোদাই করে নকশা করছিল সে। বললাম, ‘পড়াশোনা করো না?’

‘না।’

‘কেন? বাবা নাই?’

‘না।’

‘ওহ্! কবে মারা গেছে?’

‘মারা যায়নি।’

‘তাহলে?’

‘চলে গেছে।’

বালক জীবনের হঠাৎ এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির কিছুটা কারণ অন্তত জানা গেল। এরপরের ঘটনা অনুমান করে নিতে কষ্ট হচ্ছিল না। জানলাম ওর বাবার নাম মো. ইলিয়াছ। মায়ের নাম হোছনেয়ারা বেগম। মূল বাড়ি যশোর। নানা বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরের ভবানীগঞ্জ। এখানেই বেড়ে ওঠা আরমানের। দুই ভাই, এক বোন আর মাকে নিয়ে এখন আরমানদের পরিবার। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। 

আরমানের সঙ্গে আমার দেখা লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট বাজারে। আরমান যে দোকানে কাজ করছে, মালিকের নাম আবদুর রহিম। তার কাছ থেকেই জানা গেল কিছু তথ‌্য। বাবা চলে যাওয়ার পর মায়ের ভিক্ষাতেই চলে আরমানের পরিবার। কাকডাকা ভোরে সে চলে যায় লক্ষ্মীপুর সদরে। শহরের অলিগলি ঘুরে হাত পেতে যে টাকা পায়, নিয়ে ফিরে আসে ভরসন্ধ‌্যায়। তাতেও যদি জীবনের আলো ফেরে। কিন্তু সে আর ক’টাকা! ফলে থেমে যায় আরমানের পড়াশোনা। তৃতীয় শ্রেণিতেই পড়ে ফুলস্টপ! বই কেনার চেয়ে তার এখন চাল কেনা বেশি জরুরি।

   

কিন্তু চাইলেই সম্ভব নয়। চাল কিনতে টাকা লাগে। সঙ্গে লাগে অন্তত লবণ মরিচ। আরমানের মা তাকে কাজের সন্ধানে বের হতে বলেন।  

কাজটা এমন হতে হবে, যাতে শিখে ভবিষ‌্যতে সংসারের হাল ধরা যায়।

এরপরই মূলত আরমানের ঠাঁই হয় আবদুর রহিমের কাছে। সে-ও প্রায় বছরখানেক হতে চলল। কাজ শিখতে আরো এক বছর লাগবে। আরমান মনোযোগ দিয়ে কাজ শিখছে। সঙ্গে তিনবেলা খাবারসহ জামাকাপড়ও পাচ্ছে। কিন্তু সে যা চেয়েছিল তা আর পাচ্ছে কই? সহপাঠী, স্কুল, স্কুলের মাঠ তাকে এখনও ডাকে। ঘুমের ঘোরে ডুকরে কেঁদে ওঠে আরমান।

এবার একটু গভীরে যেতে চাই। জানতে চাই বাবা ছেড়ে গেল কেন? আরমান আর কথা বলে না। লক্ষ‌্য করলাম ঠোঁটজোড়া অল্প কাঁপছে। হঠাৎ আমাকে অপ্রস্তুত করে আরমানের দুচোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নিবিড় হয়ে পিঠে হাত রাখতেই ফুঁপিয়ে উঠে আরমান বলল, ‘আব্বার কুনু দোষ নাই?’

‘তাহলে?’

‘মামাদের সঙ্গে জমি নিয়া ঝগড়া হইছিল আব্বার। তখন ঘরে দরজা দিয়া আব্বারে অনেক মারছে। আব্বায় রাগ কইরা চইলা গেছে, আর আসে নাই।’

নিরুপায় আরমানের এখন সংসারের ভার কাঁধে তুলে নেয়া ছাড়া পথ নেই। যদি কাজটা শেখা হয়, তবেই সংসারের হাল ধরতে পারবে সে। জানতে চাই, ‘পড়তে ইচ্ছে করে?’

‘হু।’ এরপর আরমান নিজেকেই যেন প্রশ্ন করে, ‘কিন্তু পড়ার খরচ দিব কে? মায়ের কী হইব?’

উপজেলার প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় বাজারের পাশেই গড়ে উঠেছে স্কুল। স্কুল ড্রেস পরে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এই গলি দিয়েই ছাত্ররা যাতায়াত করে। আরমান ওদের দিকে ফিরেও তাকায় না। যদি ইচ্ছেটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এতক্ষণে বোঝা গেল মাথা গুঁজে একমনে আরমানের কাজ করার রহস‌্য। এ রহস‌্য নয়, লজ্জা। আমাদের লজ্জা।  

 

ঢাকা/তারা