সাতসতেরো

শত বছর ঘুরে বিশেই হচ্ছে মহামারি

মাত্র তিন মাস আগে নতুন বছর অর্থাৎ ২০২০ শুরু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানানোর সময় এবার অনেকেই লিখেছিলেন, ‘বিষমাখা বিশ সাল’ বা ‘জোড়া বিশ সালের শুভেচ্ছা’। নিছক মজার ছলে লেখা এই কথাগুলো মাস না ঘুরতেই অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে সেটা হয়তো কেউ ভাবেননি। কোভিড-১৯ বা নোভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে সত্যিই পৃথিবী এখন বিষময়।

ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৮৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ৪০১। এছাড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ৭৬ হাজার ৭ জন। তবে এখন পর্যন্ত ৯১ হাজার ৯৫২ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ সাল কি আসলেই বিষময় বা অশুভ? সাদা চোখে দেখলে বিশ সালকে আর দশটা সাধারণ সালের মতোই মনে হবে। এমনকি চাইনিজ সংখ্যাতত্ত্ব বা ফাংশুয়ের মতে বিশ সাল অনেক শুভ। তবে কিছু সংখ্যাতত্ত্ববিদ জোড়া সংখ্যার সালগুলোকে অশুভ মনে করেন। কেন অশুভ মনে করেন এর কিছু কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তারা। প্রমাণ হিসেবে তারা ২০০২ সালে সার্স ভাইরাসের আক্রমণ, ২০০৪ সালের ভয়াবহ সুনামি এবং ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের আক্রমণকে তুলে ধরেছেন।

সংখ্যাতত্ত্ব বা নিউমারোলজিকে হয়তো অনেকেই উড়িয়ে দিতে পারেন। তবে কাকতালীয় হলেও প্রকৃতি কিন্তু প্রতি শতাব্দীর বিশতম বছরে ভয়ানক অশুভ চিহ্নের দাগ রেখে গেছে। আজও ইতিহাস সেই ভয়ানক দাগ বহন করে চলছে। বিগত শতকগুলোতে বিশ সালে ঘটে যাওয়া কিছু আলোচিত ঘটনা নিচে দেওয়া হলো:

গ্রেট প্লেগ অব মার্সেই: প্রথমেই ঘড়ির কাটা ঘুরিয়ে যাওয়া যাক ১৭২০ সালে। বিশ শতকের মানুষের কাছে প্লেগ একপ্রকার অচেনা অসুখ। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরলস শ্রমে এই অসুখ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। তবে প্রাচীন ইতিহাস ঘাটলে অনুমান করা যায়, কতটা ভয়ঙ্কর ছিল প্লেগ। ১৭২০ সালের শুরুতেই প্লেগ হানা দেয় ইউরোপে। গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা ছিল ফ্রান্সের মার্সেই শহর। যে কারণে ১৭২০ সালের প্লেগকে বলা হয় প্লেগ অব মার্সেই। এতে এক লাখের অধিক মানুষ মারা যায়। শুধু ফ্রান্সেই মারা যায় পঞ্চাশ হাজার। কথিত আছে প্লেগের পর থেকে পরবর্তী এক শতাব্দী ফ্রান্সের জন্মহার ছিল অনেক কম।

এশিয়াটিক কলেরা: কলেরায় বর্তমানে মৃত্যুর হার অনেক কমে গেলেও কয়েক শতাব্দী আগেও তা ছিল প্রাণঘাতী। ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী কলেরার প্রকোপ শুরু হয় উনিশ শতকের বিশ সালে। ইতিহাসে এটি ‘এশিয়াটিক কলেরা’ নামে পরিচিত। এর প্রকোপ শুরু হয় মূলত ১৮১৭ সালের শেষ দিকে। সর্ব প্রথম কলকাতার ব্রিটিশ সেনা সদস্যদের মধ্যে কলেরা দেখা দেয়। এরপর আফগানিস্তান, চীন হয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮২০ সালে এসে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। এর বিস্তার ছিল ১৮৬০ সাল পর্যন্ত। ধারণা করা হয় এশিয়াটিক কলেরা প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল।

স্প্যানিশ ফ্লু: ফ্লু বা শ্বাসতন্ত্রের রোগগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম মহামারি আকারে দেখা দিয়েছেল স্প্যানিশ ফ্লু। এই রোগে ১৯২০ সালে স্পেনে হানা দেয় বলেই এর নাম করা হয়েছে স্প্যানিশ ফ্লু। জানা যায়, এই রোগে বিশ্ব্যবাপী আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় পাঁচশ মিলিয়ন মানুষ। যদিও মৃতের সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত আছে। তবে সবাই একমত হয়ছেন মৃতের সংখ্যা সতেরো মিলিয়নের কম না। স্প্যানিশ ফ্লুর সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা করোনাভাইরাসের জিনগত মিল পেয়েছেন। কারণ করোনাভাইরাস যেমন জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে আক্রমণ করছে স্প্যানিশ ফ্লুর সংক্রমণের ধরনও ছিল একই রকম।

তবে প্রতি শতকের বিশ সালে একটি করে মহামারির আক্রমণ ঘটছে বা ঘটবে এমনটা মানতে নারাজ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এই সকল ঘটনাগুলো নিছক কাকতালীয়। ইতিহাসের পাতা উল্টালে এমন হাজার কাকতালীয় ঘটনার দেখা মিলবে। এগুলোর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভাইরাসজনিত কিছু রোগ বারবার সংক্রমিত হয়। তবে সেটা কোনো সাল তারিখ মেনে হবে এমন কোনো যুক্তি নেই। ঢাকা/মারুফ/তারা