সাতসতেরো

একাত্তরের ২৬ মার্চের দৃশ্যপট

পাকিস্তানি হানাদাররা ২৫ মার্চ রাতে ইতিহাসের যে নিষ্ঠুরতম বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, পরের দিন ২৬ মার্চ ঢাকাজুড়ে ছিল তারই ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি।

১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল শুক্রবার। এমন পবিত্র দিনেও চারদিকে লাশ আর লাশ। ঢাকা যেন লাশের শহর।

একদিকে রাতের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে স্বজন হারানোর শোক, অন্যদিকে পেছনে তাড়া করছিল মৃত্যুভয়। এমন পরিস্খিতিতে স্তব্ধ থমথমে ঢাকাসহ সারাদেশ। এরমধ্যেই কিছু মুক্তিকামী মানুষ হানাদারদের প্রতিরোধে নানাভাবে সংগঠিত হতে থাকে।

মার্চের ২৬ তারিখ প্রথম প্রহরেই সারা দেশসহ ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।

এদিন ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে সারা দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সপ্তাহ খানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা...। কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে-এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেয়া হবে না।’

টানা ২৪ দিন ধরে চলা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে ঘৃণ্য গণহত্যার পথ বেছে নেয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া এবং চক্রান্তকারী পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুুট্টো।

অন্যদিকে, ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে গণহত্যা শুরুর অর্ধ ঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বলেন, “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন!”

১৯৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ১২-৩০ মিনিটে স্বাধীনতার এই অমোঘ মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ থেকে।

২৬ মার্চের সূচনালগ্নে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন তা-ই হয়ে ওঠে মুক্তিকামী জনতার সামনে এগিয়ে চলার মূলমন্ত্র।। ঘোষণাটি ছিল এরকম-

‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানার ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ- দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোস নাই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’

এই বার্তাটি-ই তখন বিপন্ন জনতার সামনে একমাত্র দিক নির্দেশনা হিসাবে কাজ করে।

বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর ও নির্বিচারে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি তাদের সর্বশক্তি নিয়ে ইস্পাতকঠিন প্রত্যয় নিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারাদেশে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবনপণ সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বাঙালী।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী দিবসের প্রথম প্রহরে রাত ১২টায় পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকার চারটি স্থানকে টার্গেট করেছিল- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, তৎকালীন ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং ধানমন্ডি ৩২নং বঙ্গবন্ধুর বাসভবন।

ভয়াল কালরাতের ধ্বংসস্তূপ আর লাশের ভেতরে দিয়ে উঠল রক্ত রাঙানো নতুন সূর্য। ভীতবিহ্বল মানুষ দেখল লাশ আর রক্তভেজা ভোর। সারি সারি স্বজনের মৃতদেহ।

 

ঢাকা/টিপু/আমিনুল