সাতসতেরো

বদলে যাচ্ছে পৃথিবী

করোনা ভাইরাস। বলা যায় এক মহাপ্রলয়। বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশেও একের পর এক শহর লকডাউন হচ্ছে। সব কিছু বন্ধ। মার্কেট, শপিং মল, সিনেমা হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উদ্যান, সৈকত, স্টেডিয়াম- সব বন্ধ। বিশ্বের আড়াইশ কোটি মানুষ এখন উদ্বিগ্ন।

সময়টা কঠিন। করোনাভাইরাস বিশ্বে বিস্তার ঘটিয়ে কেড়ে নিচ্ছে হাজারও মানুষের প্রাণ। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সবশেষ (৮ এপ্রিল) তথ্য অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮২ হাজার ৭৩ জন। এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনায় মোট আক্রান্ত ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৩৭ জন।  সুস্থ হয়েছেন ৩ লাখ ৭৬৭ জন।

এশিয়াজুড়ে করোনা

করোনাভাইরাসের বিষয়ে আলোচনা বা লেখালেখির শুরুতেই আসে চীনের নাম। কারণ প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটির উৎপত্তি এশিয়ার অন্যতম শক্তিধর দেশটিতে। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে দেশটির হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তবে বিশ্ব যখন এই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে চীন সেখানে পুরোপুরি উল্টো পথে। এ ভাইরাসের বিপক্ষে গত তিনমাসেরও বেশি সময়ের যুদ্ধে দেশটি সফল বলা চলে। চীনে এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। এজন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ১১ সপ্তাহ লকডাউনে থাকা উহান শহর। তবে এখনো কিছু কিছু স্থানে আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের সবশেষ তথ্য মতে, বুধবার (৮ এপ্রিল) দেশটিতে নতুন করে ৬২ জন আক্রান্ত হয়েছে, যার ৫৯ জনই বাইরে থেকে আসা। এ পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ লোক মারা গেছে। আক্রান্ত হয়েছে ৮২ হাজারেরও বেশি। অন্যদিকে সুস্থ হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার মানুষ।

এছাড়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশেও করোনা বিস্তার করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকা।

‘এই মহামারি নতুন দুনিয়ায় ঢোকার পথ’

বুকারজয়ী ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও লেখক অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, ‘আমাদের সঙ্গে এ কী ঘটছে? হ্যাঁ, এটি একটি ভাইরাস, যার কোনো নৈতিকতা বোধ নেই। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এটি (আমাদের কাছে) ভাইরাসের চেয়ে বেশি কিছু। কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর আমাদের মতি ফেরাতে এই উপায় করেছেন। অনেকে বলছে, এটি বিশ্বজুড়ে চীনাদের ষড়যন্ত্র। যা–ই হোক না কেন, করোনাভাইরাস শক্তিশালীদের মাথা নত করতে বাধ্য করেছে এবং বিশ্বকে এমনভাবে থমকে দিয়েছে, যা আগে কেউ পারেনি। আমাদের মন এখনো আশা করছে যে সব স্বাভাবিক হবে। এটি আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করছে, সেই ধ্বংসাত্মক যন্ত্রটি নিয়ে, যা নিজেদের জন্য তৈরি করেছি আমরাই। ঐতিহাসিকভাবে মহামারি সব সময় বিশ্বকে নতুনভাবে কল্পনা করতে বাধ্য করেছে। এটিও আলাদা নয়। এক বিশ্ব থেকে নতুন আরেক বিশ্বে যাওয়ার বাহক হলো করোনা। আমাদের সংস্কার ও হিংসা, লালসা, আমাদের তথ্যব্যাংক ও মৃত ধারণা গুচ্ছ, আমাদের মৃত নদী ও ধোঁয়াটে আকাশে বোঝাসহ আমরা এর মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে পারি। অথবা আমরা নতুন এক পৃথিবীকে কল্পনা করার প্রস্তুতি নিয়ে এসব বোঝা ছাড়াই এগোতে পারি এবং নিতে পারি এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি।’ [সূত্র: অরুন্ধতী রায়ের কলাম, দৈনিক প্রথম আলো, ৮ এপ্রিল ২০২০]

পৃথিবীর গতিবিধিও বদলে গেছে

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে শত শত কোটি মানুষ এখন কাজহীন। বলা যায় বসে আছে ঘরে। ফলে এই পৃথিবীর গতিবিধি বদলে গেছে। কারণ, মানুষ বাইরে যাচ্ছে না। গাড়ি-ট্রেন চলছে খুবই কম। লাখ লাখ ভারি শিল্প-কারখানা এখন বন্ধ। এ কারণে ভূ-পৃষ্টের ওপর চাপ কমে গেছে অনেক। ফলে পৃথিবী কাঁপছে কম। পৃথিবীর ওজন ছয় বিলিয়ন ট্রিলিয়ন টন। সেই বিবেচনায় এই পরিবর্তন বিস্ময়কর। বেলজিয়ামের রয়্যাল অব জারভেটরির বিজ্ঞানীরা বলছেন, লকডাউনের আগের তুলনায় ১-২০ হার্টস ফ্রিকোয়েন্সিতে (বড় একটি অর্গানের আওয়াজের যে ফ্রিকোয়েন্সি) ভূ-পৃষ্ঠের দুলুনি এখন অনেক কম। শুধু বেলজিয়াম নয়, পৃথিবী পৃষ্ঠের এই পরিবর্তন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভূ-কম্পন কমার বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নেপালের ভূ-কম্পবিদরা একই প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন। প্যারিস ইনস্টিটিউট অব আর্থ-ফিজিক্সের একজন গবেষক বলেছেন, ফ্রান্সের রাজধানীতে ভূ-কম্পন নাটকীয় মাত্রায় কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলস শহরে কাঁপুনি কমে যাওয়ার মাত্রা দেখে বিস্মিত হয়েছেন ক্যালটেক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা।  [সূত্র: বিবিসি বাংলা, ৭ এপ্রিল ২০২০]

লকডাউনের দূষণহীন আকাশে অচেনা তারা

করোনাভাইরাস।  ভারতজুড়ে চলছেল লকডাউন। অথচ লকডাউন ঝলমলে রাতের তারা ভরা আকাশের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। আকাশ আগের চেয়ে দশ শতাংশ আরও বেশি অন্ধকার হয়েছে।  একইসঙ্গে ৪০ শতাংশ উজ্জ্বল হয়েছে সব তারা।  দূষণহীন পৃথিবী থেকে এখন স্পষ্ট দেখা যায় শুকতারা, অর্থাৎ ভেনাস গ্রহ। কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলেন,  কলকারখানা ও যানবাহন থেকে ছড়িয়ে পড়া ধূলিকণা যে শুধু মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা ঘটায় এমনটা নয়, বায়ুমণ্ডলের ১২ কিলোমিটারজুড়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে রাজত্ব করে তারা।  আকাশ থেকে আগত ফোটন কণা বা আলোর কণা টেলিস্কোপ বা আপনার চোখ পর্যন্ত আসার আগেই ওই ধূলিকণা দেখতে পায়। সেই আলো ওই ধূলিকণায় লেগে ঠিক অন্যদিকে চলে যায়। আপনার কাছে আর পৌঁছতে পারে না।  যার ফলে অনেক তারা দেখা যেত না।  আবার বিচ্ছুরণের ফলে অনেক তারার উজ্জ্বলতা কম মনে হতো। কাজেই এখন দূষণের মাত্রা কমে যাওয়ায় অনেক তারার খোঁজ পাওয়া গেছে। এতদিন যদি ১০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত কোনও তারার সন্ধান পাওয়া যেত, করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের আকাশে এখন ২০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে থাকা তারার খোঁজ মিলছে।  অর্থাৎ দ্বিগুণ দূরের তারারাও এখন দৃশ্যমান।  [সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৫ এপ্রিল ২০২০ ]

‘বিশ্ববাসী আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে না’

করোনাভাইরাসের আগে বিশ্ববাসী যে স্বাভাবিক জীবনে ছিল সেটা ফিরে নাও পেতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন শীর্ষ মার্কিনবিজ্ঞানী ডা. অ্যান্থনিফসি। ৭ এপ্রিল হোয়াইট হাউজের সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, দেশে দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। সেখান থেকে সমাজের প্রতি স্তরে বিস্তারিত হচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতিতে আমরা হয়তো করোনাভাইরাসের আগের জীবন ফিরে পাব না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হলে আমাদেরকে করোনাভাইরাস মুক্ত হতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব কিনা জানি না। তবে একমাত্র ভ্যাকসিনই সেই সমাধান দিতে পারে।  [সূত্র: আল জাজিরা, রাইজিংবিডি, ৮ এপ্রিল ২০২০] ঢাকা/তারা